রেলওয়ে ওয়েম্যান: রেললাইন ধরে হাঁটাও যার একটা কাজ!
কখনও একজন, কখনও বা কয়েকজন। সাদামাটা পোশাকে রেললাইন ধরে হেঁটে যাওয়া দেখলে মনে হবে, হয়তো সংক্ষিপ্ত রাস্তা খুঁজতেই লাইনের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলেছেন তারা। কেউ কেউ এতই আনমনা যে রেললাইনের ঠিক মাঝ বরাবরই হেঁটে যাচ্ছেন।
কিন্তু সে ধারণা ভুল। আদোতে তারা হলেন সরকারের রাজস্বখাতভুক্ত রেলওয়ে কর্মচারী। সামান বাক্স থেকে রেঞ্জ, হাতুড়ির, শাবল, করাতের মতো জিনিসপত্র নিয়ে তারা হেঁটে বেড়ান রেললাইন ধরে। রেল বা লোহার বারের কোথাও কিছু ঢিলা হয়ে থাকলে টাইট দেন, কোথাও কাদা-মাটি জমে গেলে সেটাকে পরিষ্কার করেন, আগাছা পরিষ্কার করেন, পাথর সরে গেলে নির্দিষ্ট স্থানে এনে গুছিয়ে রাখেন; একশব্দে বলতে গেলে নিরাপদ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেই রেললাইনের মাঝে তাদের এই হেঁটে-বেড়ানো।
রেলের ভাষায় তারা হলেন 'ওয়েম্যান'। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির ১৯তম গ্রেডের কর্মচারীপদ হলো এই ওয়েম্যান।
সবচেয়ে 'ছোট পদ'
ওয়েম্যানদের বিভিন্ন গ্যাংয়ে ভাগ করা থাকে। একটি গ্যাংয়ে ১০-২০ জন সদস্য থাকে। তাদের মধ্যে একজন মিস্ত্রি বা মেট, একজন কিম্যান এবং বাকিরা ওয়েম্যান। জংশন বড় হলে ২০ জন থাকেন একেকটি গ্যাংয়ে। আবার ছোটো হলে ৭-৮ জনও থাকেন। তাদের সবার কাজ প্রায় কাছাকাছি। রেলপথ নজরদারি, রেলপথের ত্রুটি-বিচ্যুতি অনুসন্ধানসহ প্রাথমিক ত্রুটি সারানোর কাজ তাদের। তবে তা পদাবস্থানের ক্রমানুযায়ী।
যেমন— একটি গ্যাংয়ে প্রধান দায়িত্ব পালন করেন যেহেতু মিস্ত্রী বা মেট, তাই তার কাজ কিম্যান ও ওয়েম্যানদের তুলনায় কম। একজন মিস্ত্রী বা মেট গ্যাংয়ের বাকিদের কাজ দেখিয়ে দেন, সাহায্য করেন। কিম্যান ও ওয়েম্যান কাজগুলো করেন।
চাকরিতে ঢোকার পরপরই প্রথম দুইবছর শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেন তারা। যদিও বেতন সবার একই। সবচেয়ে ছোটো পদ যেহেতু ওয়েম্যানের, তাই পদোন্নতি পেলে ওয়েম্যান কিম্যানের দায়িত্ব পান, কিম্যান থেকে পরবর্তীতে মিস্ত্রীর পদে।
একজন মিস্ত্রী বা মেটের উপরে আছেন হেডমেট। তার ওপর এসিস্ট্যান্ট পার্মানেন্ট ওয়ে ইনস্টিটিউশন (এপিডব্লিউআই) এবং তারও ওপর পার্মানেন্ট ওয়ে ইনস্টিটিউশন (পিডব্লিউআই)।
একজন ওয়েম্যান সবোর্চ্চ পার্মানেন্ট ওয়ে ইনস্টিটিউশন পদে উন্নীত হতে পারেন। এ নাম বদলে এখন অবশ্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী সিনিয়র সব-এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (এসএসএই) হয়েছে। কিন্তু এখন বাইরে থেকেই এ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায়, সে সুযোগও খুব একটা নেই।
প্রতিদিন একজন ওয়েম্যান ১ রেল কাজ করেন
রুবেল (ছদ্মনাম) দশ বছর আগে এই চাকরিতে ঢুকেছিলেন বাবার পোষ্যকোটায়। তার বাবাও ছিলেন একজন ওয়েম্যান। রুবেল থাকছেন তার বাবার সময়ে পাওয়া একই কোয়ার্টারে।
ওয়েম্যানদের জন্য আগে আবাসন ব্যবস্থা ও পোষ্য কোটার সুবিধা ছিল। যদিও বর্তমানে এই পদে চাকরিরতদের জন্য কোনো আবাসন ব্যবস্থা নেই। বছর পাঁচেক আগে তুলে নেওয়া হয়েছে পোষ্যকোটাও।
তবে রুবেল চট্টগ্রামের পাহাড়তলির আমবাগান রেলওয়ে কোয়ার্টারগুলোতে মা, বোন, স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে এখনও থাকছেন। দুটি বড় ঘর এবং একটি বারান্দা নিয়ে এই একতলা বাসার সামনে রয়েছে ছোট্ট উঠোন।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বাবার পথে পা বাড়ান রুবেল। যখন চাকরিতে ঢোকেন তখন বেসিক বেতন ছিল ৪,০০০ টাকা। এখন হয়েছে ৮,০০০। বর্তমানে ১৬,০০০ এর একটু বেশি টাকা হাতে পান। বেতনের স্কেল অনুযায়ী সর্বোচ্চ ২০,০০০ টাকা (বেসিক) পর্যন্ত হবে।
রুবেলের মা তার প্রয়াত বাবার পেনশন থেকে ৫,৫০০ টাকা পাচ্ছেন এখন। আপাতত বাবার পেনশনের টাকা এবং নিজের আয়েই পাঁচজনের সংসার চলছে। ছোটো বোনকে ডিগ্রি পড়াচ্ছেন চট্টগ্রামের হাজী মহসিন কলেজে।
ওয়েম্যান থেকে শুরু করে বর্তমানে মিস্ত্রী বা মেট পদে উন্নীত হয়েছেন রুবেল। তার অধীনে ২০ জনের একটি গ্যাং। সাধারণত প্রতি গ্যাংয়ের দায়িত্বে তিন কিলোমিটার এপাশ-ওপাশ করে থাকে ছয় কিলোমিটার রেলপথ। একটি স্লিপার হতে আর একটি স্লিপারের মাঝে যে দূরত্ব তাকে বলে এক গালা। এমন ১৮ গালায় এক রেল হয়। আর এই এক রেল পরিমাণ জায়গায় প্রতিদিন একজন ওয়েম্যান ১ রেল কাজ করেন। এভাবে পুরো ছয় কিলোমিটার করতে সময় লেগে যায় চার থেকে পাঁচ মাস।
শীতকালে তুলনামূলক কাজ কম থাকে
কাজগুলো করতে হয় পায়ে হেঁটে। সঙ্গে রাখতে হয় গাঁইতি, শাবল, কোদালের মতো উপকরণ। রেলের ভাষায় কাজগুলোর নাম হলো- প্যাকিং, হুদিমারা, ব্রিজকাঠ বদল, ঢালটানা, ঘাসমারা ঝিলি মারা, ঝাড়াখোলা ইত্যাদি।
বর্ষাকালে মাটি ধুয়ে রেললাইন নিচে নেমে যায়। তখন পাথর দিয়ে প্যাকিং করতে হয়। অর্থাৎ, রেললাইনটাকে আবার সমান করতে হয়। আবার প্রখর গরমের যখন লাইন বেঁকে যায়, তখন শাবল দিয়ে মেরে মেরে তা সোজা করতে হয়। একে বলে হুদিমারা। ছায়া কম যেসব জায়গায়, যেমন ভাটিয়ারির দিকে বেশি হয় এ সমস্যা।
একইভাবে বর্ষাকালেও ঘাস, আগাছা, পানি জমে মাটি নরম হয়ে লাইন নিচু হয়ে যাওয়ার মতো নানা কাজ থাকে। শীতকালে তুলনামূলক কাজ কম থাকে। তবু অতি শীতে লাইন সংকুচিত হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। আবার অনেকে ইচ্ছে করে রেললাইনের পাথর আশেপাশে ফেলে রাখেন, সেগুলো ঠিকমতো এনে স্লিপারের চারপাশে সমান করে রাখতে হয়।
'ডিউটি টাইম' শেষে বাড়তি ৭ ঘণ্টা কাজ করেছেন এমন নজিরও কম নয়
আপাতভাবে পড়লে মনে হচ্ছেনা কাজ আর এত কই? কিন্তু স্বচক্ষে দেখলে বোঝা যায়, কাজগুলো কি পরিমাণ কায়িক পরিশ্রম আর সময় ব্যয় করে।
কখনও কখনও ৪-৫ জায়গায় একসাথে লাইন ভেঙ্গে যায়। লাইন অনেক পুরোনো বা মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এমন হয়। আবহাওয়াও দায়ী এর পেছনে। তখন এক কাজ করতেই ৪-৫ ঘণ্টা লাগে। এমনকি, 'ডিউটি টাইম' শেষে বাড়তি ৭ ঘণ্টা কাজ করেছেন, এমন নজিরও কম নয়। কিন্তু তাতে বাড়তি মজুরি বা অন্যকোনো সুযোগ-সুবিধা নেই।
যখন কোনো অংশে কাজ থাকে তখন সাময়িক সময়ের জন্য ওই লাইন বন্ধ রাখা হয়। যদি কয়েক ঘণ্টা লেগে যায় সেক্ষেত্রে ড্রাইভার এবং মাস্টারকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ওই পথ দিয়ে যাবার সময় গতিবেগ কম রাখার জন্য।
যেহেতু সারাক্ষণই ট্রেনের যাতায়াত চলতে থাকে, ফলে সার্বক্ষণিক রেললাইন তদারকি সম্ভব হয়না। হয়তো এজন্য মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনাও ঘটে। তবে সেটি সংখ্যায় অনেক কম। রেললাইনের দুর্ঘটনার পেছনে মূলত মাস্টারদের অবহেলা বা অমনোযোগিতাই দায়ী বলে মনে করেন রুবেল।
সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে গ্যাংয়ের সকলে উপস্থিত থাকেন নির্ধারিত অঞ্চলে। প্রতিদিন কী কী কাজ করতে হবে তা পিডাব্লিউআই'র অফিস থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে কাজে নামেন। দুপুরে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত লাঞ্চ ব্রেক। এরপর সাড়ে ৪টা-৫টা পর্যন্ত 'ডিউটি টাইম'। কিন্তু এ কাজে সময়ের কোনো ঠিক নেই। লিখিত কর্মঘণ্টা ৯/১০ ঘণ্টা হলেও এর বাইরে 'ইমার্জেন্সি' (জরুরি) ডাকে যেতে হয়। সে যাওয়ায় নেই দিনরাত বা ছুটির হিসাব। গভীর রাতেও যেমন ফোন পেয়ে ছুটে আসতে হয়, তেমনি ঈদের দিনও নামাজ শেষে হাজিরা দিতে হয় কাজের জায়গায় এসে। তবে যাদের বাড়ি দূরে, তাদের ঈদে ছুটি দেওয়া হয়।
নিয়োগে ছিল ঘুষ ও অনিয়মতান্ত্রিক উপায়
এরকম উচ্চঝুঁকিপূর্ণ কাজেও নেই কোনো ঝুঁকিভাতা। দুর্ঘটনা ঘটলে বা আহত হলে নিজেদেরই সে খরচ বহন করতে হয়। ওদিকে রেলওয়ে হাসপাতালগুলোর মৃতপ্রায় অবস্থা হওয়ায় চিকিৎসা সেবায়ও পাচ্ছেন না কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা। তবে অবসরে যাবার পর পেনশন এবং আঠারো বছরের নিচে শিশু ও প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে তারা ভাতা পাবে বলে জানান।
ওয়েম্যানদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনেক পুরোনো হওয়ায় রেললাইনগুলো প্রায়ই ভেঙ্গে যায়। ভেঙ্গে গেলে ওই অংশটা বা জয়েন্টটা কেটে ফেলে নতুন রেললাইন জয়েন্ট লাগাতে হয়— যা অনেক সময়সাপেক্ষ।
একবার এই রেললাইন পায়ের ওপর পড়ে পা ভেঙ্গে যায় মিজানুর রহমানের। ৭ মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। ১৭ বছর আগে, এসএসসি পাশ মিজান যখন এ চাকরিতে ঢোকেন— তখন তার বেসিক ছিল ২,৪০০; আর বেতন ছিল ৪,৮০০ টাকা। প্রতিবছর ইনক্রিমেন্টে ৩০০-৪০০ করে বেড়েছে বেতন। তার বাবা ছিলেন ট্রেনের ড্রাইভার। বলতে গেলে আবেদন করা মাত্রই তার চাকরি হয়ে গিয়েছিল। শুধু একটি মৌখিক পরীক্ষা বা বলা যায় দেখাসাক্ষাৎ পর্ব হয়েছিল বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম স্টেশনের ৮-১০ জন ওয়েম্যানের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা সবাই এই চাকরিতে এসেছেন বিনা পরীক্ষাতেই এবং টাকা (ঘুষ) দিয়ে। বহু বছর পর আবারও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এমসিকিউ এবং ভাইভা দিয়ে ওয়েম্যান নিয়োগ শুরু হয় ২০২৩ সালে।
এ বছর যারা ঢুকেছেন তারা সবাই স্নাতোকোত্তর পাস
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ১ হাজার ৭৬৭ প্রার্থীকে রাজস্ব খাতভুক্ত ওয়েম্যান পদে অস্থায়ীভাবে চূড়ান্ত নিয়োগ ও পদায়ন দেওয়া হয়। একইভাবে চলতি বছরের ৫ মার্চ চূড়ান্ত নিয়োগের পর পদায়ন হয় আরও ৪০৫ জন ওয়েম্যানের। সব মিলিয়ে এ পদে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ১৭২ জন প্রার্থী চূড়ান্ত নিয়োগ পেয়েছেন।
এ পদে আগে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল অষ্টম শ্রেণি পাস। এখন এটা এসএসসি করা হয়েছে। তবে যোগ্যতাসম্পন্ন যে কেউ আবেদন করতে পারেন।
লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্ত নিয়োগ পেয়েছেন নতুন প্রার্থীরা। তাদের প্রত্যেকেই স্নাতকোত্তর পাস। কেউ না বুঝেই কেউ বা অন্য আর কোনো চাকরি পাচ্ছেন না বলে এ চাকরিতে এসেছেন।
যেমন— খলিল রহমান (ছদ্মনাম)। ২০১৬ সালে বরিশালের বিএম কলেজ থেকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স পাশ করেন। এরপর কিছুদিন ব্র্যাক এনজিওতে ফিল্ড অফিসার পদে এবং একটি ব্যাংকে কাজ করেছেন। এরপর দীর্ঘদিন বেকারত্বের পর আবেদন করেছেন রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের ওয়েম্যান পদে। এমসিকিউ পরীক্ষা এবং একটি ভাইভার পর এ চাকরিতে যোগদান করেন তিনি।
বাড়ি বরিশাল হলেও কাজের জায়গা চাঁদপুরে। তাই রেলের আরও কয়েকজন মিলে জংশনের কাছাকাছি একটি বাসায় থাকেন তিনি। আবার সকালে ৭টার মধ্যে রান্না শেষ করে কর্মস্থলে যান। সব কাজ সেরে বাসায় ফিরে রান্না করেন রাতের জন্য। সকালে ভাত খেয়ে আসেন, রাতে গিয়ে ভাত খান। রেললাইনের ধারে কোনো ভাতঘর থাকলে খেয়ে নেন। নয়তো রুটি-চা দিয়ে পেটটাকে চাপা দিয়ে কাজে নামেন।
'একদিন ছুটি মানে ২০০ টাকা জরিমানা'
সরকারি কোনো ছুটি ওয়েম্যানদের তালিকায় নেই। সপ্তাহে একদিন তারা বিশ্রাম পান। তবে দরকার হলে সেদিনও কাজে আসতে হয়। তাই ছুটি বলতে যা বোঝায় তা নেই, বরং সপ্তাহে একদিন এভাবে 'বিশ্রাম বা রেস্ট' পান বলে মনে করেন তারা। এছাড়া মাসে ৩ দিন ও বছরে ৩০ দিন ছুটি থাকে, যদি লাইনের সব ঠিকঠাক থাকে তাহলে।
খলিল জানান, "আমরা নতুনরা বেতন পাই ১৬,০০০ টাকার একটু বেশি। আমরা যে এত ইমার্জেন্সি বা ওভার টাইম ডিউটি করি, আমাদের বাড়তি কোনো ইনকাম নেই। আমরা যেন বেশি বেশি ছুটি নেই, এই কারণে আমাদের দিয়ে খুব কষ্টের কাজ করানো হয়। তখন আপনাকে বাধ্য হয়ে ছুটি নিতে হবে। আমাদের ১ দিন ছুটি নিলে ২০০ টাকা দিতে হয়। বছরে যে ত্রিশ দিনের ছুটি পাই সি/এল এবং সি/সি/এল মিলিয়ে, সেগুলোও দেওয়া হয় না।"
"যদি টাকা দিলে ছুটি হয়, তখন রেল লাইনে কোনো দুর্ঘটনা হয় না, আর লিগাল ছুটির কথা বললেই জরুরি সেবাখাত!," বললেন খলিল।
অনেকে চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন
এই চাকরিতে কেন এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমার বাবা ব্লাড ক্যান্সারের রোগী। আমিও দীর্ঘদিন কোনো কাজ পাচ্ছিলাম না। এটা সরকারি চাকরি। তাই এখানেই এসেছিলাম। কাজের ধরণ বুঝিনি ঠিক তা নয়। কিন্তু ভেতরে যে এত অনিয়ম এবং ওয়েম্যানদের যে এত শোষিত আর বঞ্চিত করে রাখে, তা জানলে আসতাম না। অন্য জায়গায় চাকরি খুঁজছি। পেলেই চলে যাব।"
খলিলের মতোই উচ্চশিক্ষিত অনেক তরুণ এ পদে মানিয়ে নিতে পারছেন না। অনেকে চাকরিও ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
ব্রিটিশ আমলের চেয়ে কাজ ঠিকই বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা
ঝুঁকিপূর্ণ এ চাকরিতে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া নিয়মনীতিই মানা হয়। এখনও রেশন দেওয়া হয় ৫০ টাকা। অথচ, কাজের ধরন ব্রিটিশ আমলের মতো আর নেই।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে মাটির লাইন ছিল। প্রতিটি রেল স্পাতের দৈর্ঘ ছিল ৩৬ ফিট। প্রতিটি কাঠ স্লিপার উচ্চতা ৫ ইঞ্চি, রেললাইনে পাথর ছিলনা এজন্য ঝাড়াখোলা, ঢালটানা, কংক্রিটে পাথর দিয়ে শাবল প্যাকিং এগুলো ছিলনা। কাজ বলতে ছিল বালু প্যাকিং আর কাঠ স্লিপার বদল ও অন্যান্য। এছাড়া গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় ২০/৩০/৪০ কিলোমিটার।
কিন্তু ব্রিটিশ-পাকিস্তান হটিয়ে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে রেলস্পাত দৈর্ঘ্য বেড়ে হয়েছে ৪২ ফিট। কংক্রিট স্লিপার উচ্চতা বেড়ে হয়েছে ১০ ইঞ্চি। রেললাইন ট্র্যাকে পাথর ব্যাবহারের পরিমাণ বেড়েছে অনেক গুণ বেশি। এজন্য খিলি দিয়ে ঢালটানা, কংক্রিট স্লিপারে শাপল প্যাকিং, ঝাড়াখোলার মতো শারীরিক পারিশ্রম এবং জনপ্রতি কাজের পরিমাণ বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে। এখন গাড়ির গতিও ১২০ কিলোমিটার।
যেসব হাতে চালানো যন্ত্রপাতিগুলো তাদের দেওয়া হয়, সেগুলোও সারাতে হয় নিজের পকেটের টাকায়। উন্নত যন্ত্রপাতি না থাকায় এবং সব হাতে চালানো যন্ত্র হওয়ায়, এ কাজে কষ্ট, খাটুনি যেমন বেশি— তেমন দুর্ঘটনাও ঘটে বেশি।
মিজান জানান, "প্রচুর কর্মচারী অজ্ঞান হয়ে যান গরমে হিটস্ট্রোক করে। মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। আবার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে কাজ করতে গিয়ে নদীতে পড়ে যাওয়া, ট্রেনে কাটা পড়ার মতো ঘটনাও অহরহ ঘটছে।"
"আমি এই এক বছরে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর জেনেছি কাজ করতে গিয়ে। এরমধ্যে একজন ট্রেনের নিচেই কাটা পড়ে মারা যান," যোগ করেন খলিল।
যাত্রীদের যাত্রা নিরাপদ আর সুন্দর করতে ওয়েম্যানরা রাত-দিন না দেখেই কাজ করে যাচ্ছেন। করছেন ট্রলিম্যান বা অন্যরাও। কিন্তু সবচেয়ে 'ছোটো পদ' বলে অত্যাচার আর শোষণও করা হয় তাদেরকেই। যাদের এখনো সুযগ আছে, তারা অনেকেই চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু আগে নিয়োগ পাওয়া ওয়েম্যানরা না পারছেন পেশা বদলাতে, না পারছেন এই চাকরিতে টিকে থাকতে। একে তো অমানবিক শারীরিক পরিশ্রম, বেতনভাতার এই দৈন্যতা— তারওপর চলছে তাদের পাওনা ছুটি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যবসা।
যুগের পর যুগ ধরে হওয়া তাদের সাথে এসব অন্যায় বঞ্চনার প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছেন রেলপথের লড়াকু এই সৈনিকরা। ইতোমধ্যে ব্রিটিশ আমলের রেখে যাওয়া নিয়মগুলো সংস্কার করে নতুন বৈষ্যমহীন একটি বেতন পে-স্কেলসহ ১২ দফা দাবির একটি স্মারকলিপিও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেছেন ওয়েম্যানরা।