চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ: পর্যটন মৌসুমে চাহিদা থাকলেও চালু হয়নি বিশেষ ট্রেন, নেই বাড়তি কোচ
পর্যটন মৌসুমে চাহিদা বেশি থাকা সত্ত্বেও, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল রুটে এবার বিশেষায়িত কোনো ট্রেন কিংবা বাড়তি কোচ যুক্ত করেনি বাংলাদেশ রেলওয়ে। এতে কিছুটা বিপাকে পড়েছেন এই রুটের যাত্রী ও পর্যটকরা।
নিয়মিত সার্ভিসের পাশাপাশি ঈদ, পূজা, ইজতেমাসহ ছুটির মৌসুমে যাত্রী চাহিদা বিবেচনায় এই রুটে বিশেষায়িত ট্রেন পরিচালনা করে থাকে রেলওয়ে। এছাড়া, বিশেষ পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত কোচ যুক্ত করেও যাত্রীদের চাহিদা মেটানো হয়। এতে বিশেষ পরিস্থিতিতে সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি বাড়তি আয়ও হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সেবা প্রতিষ্ঠানটির। তবে চলতি ডিসেম্বরে কক্সবাজার রুটে বিপুল চাহিদা থাকলেও কোনো উদ্যোগ নেয়নি রেলওয়ে।
গত এক সপ্তাহ ধরে কক্সবাজারে পর্যটকদের ভিড় বেড়ে চলেছে। চলতি মাস পুরোটাই থাকবে এই মৌসুম। বিভিন্ন স্কুল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেট গ্রুপের পক্ষ থেকে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাড়তি সার্ভিস দিতে না পারার বিষয়টিকে রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে কক্সবাজারমুখী বিশেষায়িত ট্রেনের চাহিদা ছিল। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্পোরেটদের থেকে অনেক আবেদন ও চিঠি জমা পড়েছিল। কিন্তু বিশেষায়িত ট্রেন চালু না হওয়ায় তাদের সেবা নিশ্চিত করা যায়নি।
এছাড়া, চলতি বছরের ২৯ অক্টোবর রেলভবনে অনুষ্ঠিত টিকিট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় বিভিন্ন ট্রেনে বাড়তি কোচ সংযোজনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। মূলত টিকিট কালোবাজারি রোধ, অব্যবস্থাপনা ও পাওয়ারকারের সক্ষমতা সংক্রান্ত কারণে বাড়তি সংযোজন বন্ধ করা হয়।
যদিও প্রতিটি বাড়তি কোচের টিকিটে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের সুযোগ ছিল বলে জানান স্টেকহোল্ডাররা।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যাত্রী সেবার জন্য কক্সবাজার রেল সংযোগ করা হয়েছে। পর্যটন মৌসুমে ট্রেন পরিচালনা না করলে এই রুটে কখন করা হবে?"
"বিপুল চাহিদা ছিল। বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়েজন ছিল এখনই," যোগ করেন।
রেলওয়ের এক অভ্যন্তরীণ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত রেলওয়ে পরিচালিত ২৭টি বিশেষায়িত ট্রেনে সর্বমোট যাত্রী পরিবহন হয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার ২৯৫ জন। এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বেশি।
রেলের নিয়মিত আয়ের পাশাপাশি ছুটির দিনের বন্ধ থাকা বা পড়ে থাকা রেক (বিভিন্ন কোচ ও ইঞ্জিন দিয়ে তৈরি ট্রেন) দিয়ে বাড়তি ট্রেন চালানো হয়েছিল।
চাহিদার ভিত্তিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সাবাজার রুটে চলতি বছরের ১০ থেকে ১৩ অক্টোবর এবং ২৩ থেকে ২৭ অক্টোবর দুই দফায় ৮টি করে মোট ১৬টি বিশেষায়িত ট্রেন পরিচালনা করেছিল রেলওয়ে। ৭,২১৬ জন যাত্রী পরিবহন করে প্রায় সাড়ে ১ কোটি ১৪ লাখ ৯১ হাজার ১১৪ টাকা আয় হয় এ সময়।
পর্যটনে প্রভাব
কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে দৈনিক কয়েক হাজার পর্যটকের আগমন হচ্ছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে।
তারা জানান, হোটেল-মোটেল জোনে তারকা মানের হোটেলসহ নানা ক্যাটাগরির ৫০০ এর বেশি হোটেল রয়েছে। এসব আবাসনে দৈনিক ১ লাখ ৩০ হাজার পর্যটক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার টিবিএসকে বলেন, "পর্যটক মৌসুমে বেশি ট্রেন চালুর করা হলে পর্যটকদের কষ্ট কমে। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন। তারা ট্রেনে স্বস্তিবোধ করেন।"
"আমরা রেলওয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম পর্যটন মৌসুমে অতিরিক্ত ট্রেন চালুর জন্য। তারা প্রথমে আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু পরে আর চালু করেনি," বলেন তিনি।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথটি গত বছরের নভেম্বর মাসে উদ্বোধন করা হয়। এরপর ডিসেম্বরে ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত আন্তঃনগর ট্রেন চালু হয়।
ইঞ্জিন, কোচ ও লোকবল সংকট দেখিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন চালু হয়নি। পরে অবশ্য ক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে চট্টগ্রামের যাত্রীদের জন্য দুটি কোচ বরাদ্দ রাখা হয়। জানুয়ারিতে চালু হয় আরেকটি আন্তঃনগর ট্রেন। এছাড়া, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে একটি বিশেষ ট্রেন চলে।
রেলওয়ের পরিবহন ও যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, সবকটি ট্রেন চালাতে প্রয়োজন ৩,০০০ এর বেশি কোচ এবং প্রায় ৫০০ লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন)। কিন্তু রেলে বর্তমানে মোট কোচ আছে আড়াই হাজারের কিছু বেশি এবং ৩ শতাধিক ইঞ্জিন। মূলত এ কারণেই কক্সবাজার রুটের জন্য নতুন ইঞ্জিন ও কোচ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
রেলওয়ের উপ-উপরিচালক (টিসি) আনসার আলী টিবিএসকে বলেন, "এই রুটে ট্রেনের চাহিদা আছে। কিন্তু সংকটের কারণে ট্রেন চালু করা যায়নি। আর অতিরিক্ত কোচ সংযোজন বন্ধ করেছে কর্তৃপক্ষ। এরপরও কোচ হাতে থাকলে, প্রয়োজনীতা অনুসারে কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে সংযোজন করা হয়।"
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে রেলের উপ-পরিচালক (মার্কেটিং) শাহ আলমের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। তবে শাহ আলমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, "রেলওয়ের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জনবল ও লোকোমোটিভ সংকটে বাড়তি ট্রেন চালানো যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে নতুন ১৫টি লোকোমোটিভ ওভারহোলিং এর জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এসব ইঞ্জিন প্রাপ্তি সাপেক্ষে দেশের বিভিন্ন রুটে নতুন ট্রেন সার্ভিস শুরু যাবে।"