গরুর মতো শিং ও খুরওয়ালা শিশু জন্মদানের ভয় থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের প্রথম টিকাবিরোধী আন্দোলন
বিশ্বের প্রথম টিকা আবিষ্কৃত হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, ব্রিটেনে। ওই সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ রোগ গুটিবসন্ত প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়েছিল এ টিকা।
কিন্তু ব্রিটিশদের বড় একটা অংশ এ টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান ছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল টিকা নেওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা অন্ধত্ব, বধিরতা, আলসার, চামড়ার অসুখে আক্রান্ত হবে। এছাড়াও বহু ব্রিটিশের বিশ্বাস ছিল যে, গরুর রোগের জীবাণু থেকে তৈরি টিকা নিলে তাদের মাথায় শিং ও পায়ে খুর গজাবে।
এর মাধ্যমেই সূত্রপাত হয় পৃথিবীর প্রথম টিকাবিরোধী আন্দোলনের।
গরুর রোগের জীবাণু থেকে তৈরি টিকায় গুটিবসন্ত প্রতিরোধ হবে—এ খবর শুনেই রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে ওঠে একদল ব্রিটিশ। টিকার বিরুদ্ধে গড়ে তোলে প্রবল মতবাদ। এর পরের ১০০ বছরে আরও বড় আকার নেয় এই টিকাবিরোধী আন্দোলন।
পশুর শরীরের রোগজীবাণু মানুষ নিজের শরীরে নিতে চায়নি। এছাড়া চিকিৎসাগত, ধর্মীয়, এমনকি রাজনৈতিক কারণেও লোকে জন্য টিকা নিতে অস্বীকার করে।
আরেকটা বড় সমস্যা ছিল টিকাদান পদ্ধতি নিয়ে। এই টিকা সবচেয়ে কার্যকরভাবে দেওয়ার পদ্ধতি ছিল একজনের শরীর থেকে জীবাণু নিয়ে আরেকজনের শরীরে ঢোকানো। অর্থাৎ একজনের বাহুতে প্রথম এই টিকা দেওয়া হবে। এর এক সপ্তাহ পর যখন সেখানে গরুর গুটিবসন্তে পুঁজ তৈরি হবে, তখন ডাক্তার ওই গুটি কেটে পুঁজ সংগ্রহ করে আরেকজনের শরীরে সেটা স্থানান্তর করবেন। এটাও মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল।
টিকা ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় ব্রিটিশরা। টিকাবিরোধীরা নানা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব দাঁড় করে তাদের দাবি শক্তিশালী করার জন্য।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা-বিষয়ক ইতিহাসবিদ ফ্রাঙ্ক স্নোডেন জানান, টিকাবিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে বিশাল আকার ধারণ করে। অনেক বুদ্ধিজীবীও এ আন্দোলনের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন।
১৯ শতকে সাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে গুটিবসন্তে। ইউরোপে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৪ লাখ মানুষ মারা যায়। আর গুটিবসন্তে ভুগেও যারা বেঁচে যায়, তাদের মধ্যে স্থায়ী অঙ্গবিকৃতি দেখা দেয়।
এডওয়ার্ড জেনার টিকা আবিষ্কারের পর এ অবস্থায় পরিবর্তন আসে। যদিও মানুষকে টিকা নেওয়াতে রাজি করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। জেনার লক্ষ করেছিলেন গোয়ালিনীরা গুটি বসন্তের মড়ককালে আক্রান্ত হয় না। তা দেখে তিনি এক তরুণীর হাতের গোবসন্তের তাজা গুটি থেকে খানিকটা তরল পুঁজ নিয়ে ৮ বছর বয়সি এক ছেলের শরীরে প্রবেশ করান। এরপর দেখেন ছেলেটি কিছুদিন হালকা জ্বর ও ক্ষুধামন্দায় ভুগে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে। এভাবেই জেনার আবিষ্কার করেন গুটিবসন্তের প্রতিষেধক।
জেনারের আবিষ্কারে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদরা উল্লসিত হয়ে উঠলেও অনেকেই এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। রোগের জীবাণু—তাও পশুর রোগের—মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে গুটিবসন্ত প্রতিরোধ করে ফেলা যাবে, অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করতে চাইল না। কেউ কেউ টিকাকে মানুষের ঈশ্বরপ্রদত্ত নিরাময়-ক্ষমতার পরিপন্থি বলে প্রচার করতে থাকে।
টিকার বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী সব বক্তৃতা দেওয়া হতে থাকে। বিলি করা হতে থাকে লিফলেট। বিপুল প্রচারণার ফলে ব্রিটেনে টিকাবিরোধী আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। ১৮০৫ সালের এক প্যাম্ফলেটে উইলিয়াম রাউলি নামে রয়্যাল কলেজ অভ ফিজিশিয়ানস-এর এক সদস্য টিকার বিরুদ্ধে সতর্কবাণী দেন। তিনি বলেন, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ।
রাউলি এ-ও বলে বসেন যে, মানুষের শরীরে গরুর রোগের জীবাণু প্রবেশ করালে মানুষ দেখতে গরুর মতো হয়ে যাবে। তিনি দাবি করেন, এ টিকা নিলে মানুষের মাথায় শিং ও পায়ে খুর গজাবে। এই দাবিকে জোরালো করার জন্য অসংখ্য ছবি এঁকে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়। নিরক্ষর ব্যক্তিরাও ওসব ছবি দেখে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে যে, টিকা নিলে মানুষ গরুর মতো হয়ে যাবে।
রাউলি আরও লেখেন যে, কারও শরীরে গরুর রোগের জীবাণু প্রবেশ করালে শুধু ওই ব্যক্তিরই ক্ষতি হবে না, তার পুরো বংশই নির্বংশ হয়ে যাবে। রাউলি লেখেন, 'নোংরা জন্তুর রোগে আক্রান্ত কোনো লোকের পরিবারের সঙ্গে কে বিয়ের সম্বন্ধ করতে যাবে?'
এছাড়াও টিকাবিরোধীরা প্রচারণা চালায় যে, গুটিবসন্তের টিকা নিলে মানসিক ভারসাম্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। চিকিৎসক বেঞ্জামিন মজলি দাবি করেন, জেনারের টিকা 'গরু-উন্মাদনা'র সৃষ্টি করবে। গরু উন্মাদনা হলো এক ধরনের হিস্টিরিয়া, যার ফলে নারীরা ষাঁড়ের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে এবং আধা-মানবশিশুর জন্ম দেয়।
মজলি ও রাউলি একজোট হয়ে সারা দেশ ঘুরে ঘুরে টিকার বিরূপ প্রভাবের ওপর বক্তৃতা দিতে থাকেন। মানুষকে টিকা থেকে দূরে রাখার পেছনে এই চিকিৎসকদের অর্থনৈতিক স্বার্থও ছিল। তারা দুজনের প্রাচীন পদ্ধতিতে টিকা দিতেন। গুটিবসন্তের ক্ষত থেকে পুঁজ নিয়ে সেটি তারা সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করাতেন টিকা হিসেবে। প্রাচীন এই পদ্ধতি টিকাদানের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিয়ে বহু রোগী মারা যায়।
তাছাড়া ব্রিটেনে তখন অনেক জড়িবুটিওয়ালা হাতুড়ে চিকিৎসকও ছিল। তারাও মানুষকে জেনারের টিকার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে।
১৮৫৩ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে শিশুদের জন্য গুটিবসন্তের টিকা বাধ্যতামূলক করা হলে টিকাবিরোধী আন্দোলন আরও তীব্রতা পায়। ব্রিটেনের নগরে-বন্দরে টিকাবিরোধী সংগঠনও গড়ে ওঠে। টিকার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে রাস্তায় নেমে আসে লোকে।
মানুষের এই টিকাবিরোধিতার ফায়দা লোটে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলও। টিকাবিরোধিতার আড়ালে সরকারের ওপর জনগণকে খেপিয়ে তোলেন কোনো কোনো রাজনীতিবিদ। টিকা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হলে এই সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির করে তোলে কিছু রাজনৈতিক দল।
তবে টিকাবিরোধী আন্দোলন সত্ত্বেও গুটিবসন্তের টিকাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করার সুফল পাওয়া যায় অনেকাংশেই। কয়েক বছরের ব্যবধানে গুটি বসন্তে মৃত্যুর হার এক-চতুর্থাংশ কমে যায়। শিশুদের মধ্যে টিকাদানের ফল আরও ভালো পাওয়া যায়—তাদের মৃত্যুহার কমে যায় ৫০ শতাংশ। আর ১৯৩৪ সালে—জেনারের আবিষ্কারের প্রায় ১৩৮ বছর পর—ব্রিটেন থেকে গুটিবসন্ত বিদায় নেয়। আর বাংলাদেশে সর্বশেষ গুটিবসন্ত দেখা যায় ১৯৭৪ সালে।
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট