‘কিং অব ঢাকা’র ড্যাপার বেসপোক, ফ্যাশনসচেতন কেতাদুরস্ত তরুণেরা কেন যাবে সেখানে?
বিগত কয়েক বছর ধরে রাজধানী ঢাকার কেতাদুরস্ত ও ফ্যাশনসচেতন মানুষের চাহিদা মিটিয়ে টেইলারিংয়ের ময়দানে পাকাপোক্ত অবস্থান করে নিয়েছে ড্যাপার বেসপোক টেইলারিং। মেনজ ফ্যাশনের যাবতীয় পোশাক ক্রেতার চাহিদা ও পছন্দসইভাবে দক্ষ কারিগর দিয়ে নির্মাণ করা হয় এখানে। শার্ট-প্যান্ট, ব্লেজার-কোট, সাফারি-শেরওয়ানি, জ্যাকেট-শ্যাকেট, স্যুট সবই বানানো হয়।
ড্যাপার বেসপোকের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শাহজামান মজুমদার ছিলেন একজন ফ্যাশন আইকন। তিনি 'কিং অব ঢাকা' নামে একটি ব্লগ চালাতেন যেখানে প্রতিদিনের পোশাক-পরিচ্ছদের ছবি আপলোড দিয়ে বিস্তারিত একটি বর্ণনা জুড়ে দিতে ভালোবাসতেন। ব্লগ পড়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করলে সাগ্রহে সেগুলোর উত্তর দিতেন।
শাহজামান মজুমদার পেশায় ছিলেন একজন ইনফরমেশন টেকনোলজিস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ-তে পড়ার সময় তিনি ফ্যাশনের ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন হয়ে ওঠেন। আইবিএ-এর ফুল ব্লু স্যুটের কালচার তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
শাহজামান মজুমদারের ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করতে করতে তার একমাত্র পুত্র সেজান মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'আমার মনে হয়, বাবার ভেতরে ফ্যাশন সচেতনতা জাগাতে সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিলেন আমার বড় ফুপা। ফ্যাশনের ওপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না নিলেও তিনি এই টপিকগুলোর ওপর প্রচুর পড়াশোনা করতেন।'
'বাবা সবসময় ফিটফাট থাকতে পছন্দ করতেন। তার একটি কালার উইল ছিল যেটি দেখে তিনি ঠিক করতেন কবে কোন রঙের, কোন কাপড়ের স্যুট পরবেন। তিনি নিজের জুতা নিজে পালিশ করতেন। আমি বাবার ব্লগের জন্য ছবি তুলে দিতাম। ছবিগুলো আপলোড দিয়ে তিনি সেদিনকার পরা পোশাকের ব্যাপারে এক বিরাট ইতিহাস লিখে দিতেন। সবার প্রশ্নের উত্তর দিতেন। নতুন প্রজন্মকে ফ্যাশন সম্পর্কে জানাতে পছন্দ করতেন।'
শাহজামান মজুমদারের আরেকটি পরিচয় তিনি একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা। বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত শাহজামান মজুমদার মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিন নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর তিনি একজন।
হাতেকলমে কখনো টেইলারিং না করলেও সুই-সুতা, সেলাই-কাপড়ের ব্যাপারে তার ছিল অগাধ জ্ঞান। আমিনুল ইসলাম বাবু নামক একজন দর্জিকে সাথে নিয়ে ২০১৪ সালে তিনি শুরু করেছিলেন ড্যাপার বেসপোক টেইলারিং।
আমিনুল ইসলাম বাবু ড্যাপার বেসপোক টেইলারিংয়ের প্রথম মাস্টার। এখনও ড্যাপারের কাপড় সেলাই করে যাচ্ছেন বাবু। গল্পের ছলে বলেন, 'বিদেশে ঘুরতে গেলেই শাহজামান স্যার শার্ট-প্যান্টের কাপড়, রেডিমেড স্যুট, বোতাম ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। সেগুলো এলিফ্যান্ট রোডে আমি যে দোকানে কাজ করতাম সেখানে নিয়ে এসে সেলাই করিয়ে নিতেন। ২০০৫-০৬ সাল থেকে তিনি নিয়মিত আমার কাছ থেকে স্যুট বানাতেন। সবসময় তার দুইটা স্যুটের কাপড় আমার স্টকে থাকত।'
এভাবে তার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে বাবুর। কয়েক বছর স্যুট বানানোর পরে মজুমদার একদিন বাবুকে অফিসে ডেকে তাকে সাথে নিয়ে নতুন টেইলারিং শপ খোলার প্রস্তাব দেন। বাবু তিন মাস সময় নেন। এর মধ্যে মজুমদার হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁয়ের লবিতে দোকান ভাড়া নেন। মিরপুরে দোকানের কারখানা বসানো হয়।
হক নামক আরেকজন দর্জি মাস্টারকে সাথে নিয়ে শো-রুম ও কারখানা গোছানোর কাজে লেগে পড়েন আমিনুল ইসলাম বাবু। ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ-তে ড্যাপার বেসপোক টেইলারিং-এর উদ্বোধন করা হয়।
সারাদিন অফিস করে বিকালে শাহজামান মজুমদার নিয়মিত ড্যাপারে বসতেন। সব ধরনের মেনজ ফ্যাশনওয়্যার বানালেও ড্যাপারের মূল ফোকাস ছিল বেসপোক স্যুটের দিকে।
বেসপোক স্যুট প্রচলিত মেশিনে সেলাইকৃত ফিউজিং স্যুটের চেয়ে আলাদা। এটির অধিকাংশ হাতে সেলাই করা হয়। ফিউজিং স্যুটে শরীরের সামনের অংশে ক্যানভাস বা বক্রোম আঠা দিয়ে লেমিনেটিং করে দেওয়া হয়। বেসপোকে পুরোটা হাতে সেলাই করে লাগানো হয়। সৌন্দর্যে ও স্থায়িত্বে বেসপোক ফিউজিং স্যুটের চেয়ে বেশি মানানসই। স্যুট ছাড়া শার্ট, জ্যাকেটও বেসপোকে সেলাই করা হয়।
প্রথমদিকে ড্যাপার থেকে মজুমদার নিজে এবং তার পরিচিতজনেরা স্যুট বানাতেন। কেউ স্যুট বা অন্য কোনো পোশাক বানাতে এলে তাকে তার শারীরিক গড়ন, রুচি, বয়স, কোন অনুষ্ঠানের জন্য স্যুট বানাচ্ছে ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রকম পরামর্শ দেওয়া হত, যে ধারা এখনো বজায় আছে।
সোনারগাঁয়ের পরে গুলশান-১ এর হলিডে ভিলাতে ড্যাপারের আরেকটি শাখা খোলা হয়। সেখান থেকে পুলিশ প্লাজায় চারটা দোকানের একটা ব্লক ভাড়া নিয়ে শাখা স্থানান্তরিত করা হয়। পুলিশ প্লাজায় ক্রেতার যাতায়াতের অস্বস্তির দিকটি লক্ষ করে শাহজামান মজুমদারের ছেলে সেজান মজুমদার পুলিশ প্লাজার শাখাটি বনানীর ব্লক ই-য়ের ১২ নম্বর রোডের ৪৪ নম্বর হাউজের নয়তলায় স্থানান্তরিত করেন।
সেই থেকে ড্যাপার টেইলারিং বনানীতে। বাবা-ছেলে দুই ব্রাঞ্চে নিয়ম করে বসা শুরু করেন। ২০২০ সালে মৃত্যর আগ পর্যন্ত শাহজামান মজুমদার নিজের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করেছেন ড্যাপার। বর্তমানে ড্যাপারের পরিচালক তার পুত্র সেজান মজুমদার।
ড্যাপারে কেউ স্যুট বানাতে এলে প্রথমে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় কোন উদ্দেশ্যে তিনি স্যুট বানাতে চান। এটি জানার পরে শারীরিক গড়নের ওপর ভিত্তি করে তাকে ড্যাপারের দক্ষ কারিগর এবং পরিচালক কাপড়, স্যুটের ল্যাপল-পকেট-বোতাম ইত্যাদির ব্যাপারে পরামর্শ দেন।
ড্যাপারের জেনারেল ম্যানেজার মোঃ জুয়েল রানা বলেন, 'বিয়েশাদীর মতো অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বা রাত্রিকালীন কোনো পার্টিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্যুট বানাতে চাইলে গাঢ় রঙের কাপড় সাজেস্ট করি আমরা। শরীরের মাপ নেওয়ার পরে তার ছবি নেওয়া হয়। ছবির সাথে পোশাকের মডেল মেলানো হয়।'
'শার্টের অনেক রকম কলার আছে আমাদের স্টকে। কাস্টমারের পছন্দ অনুযায়ী কলার দেওয়া হয়।'
ড্যাপারের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হল, এখানে কাস্টমার ঠিক যেমন চান সেরকমভাবেই তার কাপড় সেলাই করে দেওয়া হয়। পুরুষের শারীরিক গড়ন, চলতি ও সেকেলে স্টাইল, আবহাওয়া ও দেশভেদে পোশাকের বিচিত্রিতার ব্যাপারে শাহজামান ও সেজান ব্যাপক পর্যবেক্ষণ ও পড়াশোনা করেছেন।
শাহজামান মজুমদার মেনজ ফ্যাশন নিয়ে প্রচুর নিরীক্ষা করতেন। বাবার দেখানো পথেই হেঁটেছেন সেজান মজুমদার। তিনি বলেন, 'আমরা মনে করি না স্যুট ইজ আ স্ট্রিক্ট ফর্ম অব ওয়্যার। শুধু স্যুট না, যেকোনো পোশাকের ব্যাপারেই আমাদের একই ধারণা। আমরা টেইলারিং ও ফ্যাশনের বেসিক রুলগুলো মেনে কাপড় বানানোর চেষ্টা করি।'
'বেসপোক টেইলারিং মানে হুটহাট স্যুট বানানো নয়। এটি কাপড় সেলাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়। বেসপোক টেইলারিংয়ে স্যুট বা কাপড় বানানোর অর্থ যার শরীরের মাপে এটি বানানো হচ্ছে সেটি শুধু তার শরীরেই নিখুঁতভাবে ফিট হবে।'
শার্টম্যান আর স্যুটম্যান
ড্যাপারের কাপড়ের কারিগরদের সাথে কথা বলেও দারুণ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। একদম প্রথম ধাপেই একজন কারিগর স্যুট বানাতে পারেন না। শার্ট বা হালকা ধরনের সেলাইয়ের কাজ দিয়ে প্রত্যেকের হাতেখড়ি হয়। শার্ট থেকে প্যান্ট। প্যান্ট থেকে কোট। সবশেষে স্যুটের কাজ শিখে তাদের শিখন শেষ হয়।
স্যুটের কারিগর মেনজ ফ্যাশনের সবচেয়ে দক্ষ ও সূক্ষ্ম কারিগর। একেক ধরনের পোশাক বানাতে বানাতে কারিগর একেকটি পোশাকে দক্ষ হয়ে ওঠেন। যিনি শার্ট বানান তাকে বলা হয় শার্টম্যান, যিনি প্যান্ট বানান তাকে বলা হয় প্যান্টম্যান, যিনি স্যুট বানান তাকে বলা হয় স্যুটম্যান।
কারিগর ও মাস্টার শব্দ দুটো এক মনে হলেও দর্জিদের ভাষায় দুটো আলাদা অর্থ বহন করে। মাস্টার শোরুমে থেকে কাস্টমারের শরীরের মাপ নেন, তারপর সে মাপ অনুযায়ী কাপড় কেটে কারখানায় পাঠিয়ে দেন। কারিগর কারখানায় বসে পাঠানো কাপড় সেলাই করেন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগরেরা একসময় মাস্টার হন। উল্লেখ্য, প্যান্ট ও স্যুটের কাপড়ের কাটিং সাধারণত একজন মাস্টারই করে থাকেন।
ড্যাপারে একটি কাপড় পুরোপুরি স্যুটে পরিণত হয়ে কাস্টমারের গায়ে ওঠা পর্যন্ত কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে। শোরুমে বা দোকান থেকে কাটিং করে কাপড় কারখানায় পাঠানো হলে সেখানকার কারিগরেরা কাস্টমারের শরীরের মাপ অনুযায়ী হাতে সেলাই করে পোশাকের একটি অবয়ব দাঁড় করান। সেটি প্রথম ট্রায়ালের জন্য শোরুমে পাঠানো হয়। প্রথম ট্রায়ালে হাতা ও স্যুটের ঝুল, বডির মাপ এরকম বেসিক বিষয়গুলো ঠিক আছে কিনা দেখা হয়।
দামি কাপড় হলে অনেক সময় প্রথম সেলাই করা হয় কম দামি কাপড়ের ওপর। বিশেষ কৌশলে পুরোপুরি হাতে করা সেলাইগুলো পরে খুলে ফেলা হয়। খুলে ফেলার পরেও কাপড়ের গায়ে কোনো দাগ থাকে না বা কাপড় নষ্ট হয় না।
দ্বিতীয় ট্রায়ালে বোতামের ঘরগুলো কেটে ঠিক করা হয়। সেখানেও হাতের সেলাইয়ের কাজ চলে।
ড্যাপারের স্যুট কাটিং মাস্টার মিলন দত্ত বলেন, 'যারা ফিট প্রথম ট্রায়ালেই তাদের স্যুটের সমস্যাগুলো ঠিক করা যায়। তবে কারো পেটে মেদ থাকলে, কেউ একটু কুঁজো হলে বা অন্য যে কোন সমস্যা থাকলে সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রায়ালে যেতে হয়।'
একজন কারিগরের হাতেই বেসপোক স্যুট বোনা হয়। একটি স্যুট শেষ করতে একজন কারিগরের কমপক্ষে তিন দিন সময় লাগে।
কাস্টমার এবং ড্যাপার দু'পক্ষই পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত স্যুট কাস্টমারের হাতে দেওয়া হয় না। কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে শিক্ষিত ও বোদ্ধাদের পছন্দের শীর্ষে ড্যাপারের অবস্থান।
ড্যাপার টেইলারিং শপ হলেও কাস্টমারদের জন্য স্যুটের কাপড়, বোতাম, টাই, পকেট স্কয়ার ইত্যাদি শোরুমে সাজিয়ে রেখেছে। শোরুমে দেশি-বিদেশি নানা ধরনের কাপড় ও বোতামের নমুনা বা ক্যাটালগ রাখা আছে।
ইতালিয়ান, ব্রিটিশ, স্প্যানিশ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের উল, লিনেন, সিল্ক লিনেন, উল লিনেন কাপড় ও কাপড়ের ক্যাটালগ দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী সেগুলো অর্ডার দেওয়া হয়। দেশের ভেতর থেকেও কয়েকটি কাপড় সংগ্রহ করা হয়।
কাপড়ের উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ডের মধ্যে আছে– জেনিয়া, চেরুটি, হলেনশেয়ারি, প্লাটিনো, ভিবিসি, স্ট্যাবেলো ইত্যাদি। এগুলোর অধিকাংশ ইতালি থেকে আমদানি করা হয়।
দামি বোতামের মধ্যে রয়েছে– এমওপি (মাদার অব পার্ল, যেটি ঝিনুক থেকে তৈরিকৃত), হর্ন বাটন (মহিষের শিং থেকে প্রস্তুতকৃত), কোরোজো (দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা হয়), লেদার বাটন (পশুর চামড়া থেকে প্রস্তুতকৃত), বোন বাটন (হাড় থেকে তৈরি), কোকোনাট বাটন (নারিকেলের উপরের শক্ত আবরণ থেকে তৈরি) ইত্যাদি।
জুয়েল রানা জানান, 'প্রথমদিকে ড্যাপারের জন্য দামি, ক্লাসিক্ল্যাল বাটনগুলো শাহজামান স্যার বিদেশে গেলে সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। এখন আমরা ফেডএক্সের মাধ্যমে সরাসরি বাটন ও কাপড় নিয়ে আসি।'
ড্যাপার থেকে কাপড় না কিনে শুধু শার্ট বা স্যুট বানানোর খরচটি জেনে নেওয়া যাক। টু-পিস স্যুটের মজুরি পড়বে ১৬ হাজার টাকা, থ্রি-পিসে পড়বে ২০ হাজার টাকা। কোটি বা নেহেরু জ্যাকেটের মজুরি ধরা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। শার্ট বানানোর খরচ পড়বে এক থেকে তিন হাজার টাকা। শার্টের কাপড়ের ধরন, কাস্টমারের রুচি ইত্যাদির ভিন্নতার কারণে মজুরিতে পার্থক্য তৈরি হয়।
দামি কাপড়ের শার্টের ক্ষেত্রে প্রথমে একটি কমদামি নমুনা কাপড়ে শার্টের অবয়ব ফোটানো হয় বলে খরচ খানিকটা বেড়ে যায়।
ড্যাপার থেকে কাপড় কিনলে মজুরির সাথে কাপড়ের দাম যোগ করা হয়। ড্যাপার থেকে কাপড় নিয়ে স্যুট বানাতে সর্বনিম্ন খরচ পড়বে ৩৫ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ প্রায় ৬ লাখ টাকা।
জুয়েল রানা আরো বলেন, 'ড্যাপারে স্যুট বানানোর খরচ ফেরদৌস টেই্লার, টপ টেন, রেমন্ডের মতো অন্য টেইলারিংগুলোর চেয়ে খানিকটা বেশি। পুরোপুরি হাতে সেলাই বা বেসপোক ধরনের কাজ করা হয় এখানে। কয়েকটা ট্রায়াল নেওয়া হয়। খুব যত্ন সহকারে সূক্ষ্ম কাজগুলো করা হয়। এসব কারণেই মেকিং কস্ট আমাদের এখানে একটু বেশি পড়ে।'
ড্যাপার থেকে কাপড় নিয়ে স্যুট বানালে কাস্টমারদের একটি বিশেষ সার্ভিস দেওয়া হয়। বানানোর সময় প্রায় চার ইঞ্চি কাপড় স্যুটের ভেতর রেখে দেওয়া হয়। তিন মাসের ভেতর স্যুট ঢিলা করার দরকার হলে কোনো চার্জ ছাড়া সেটি করে দেওয়া হয়। তিন মাস পড়ে একটা নির্দিষ্ট অ্যামাউন্ট চার্জ করা হয়। কলার, বোতামও বদলে নেওয়া যায়।
গত কয়েক বছর ধরে ড্যাপার থেকে স্যুট ও শার্ট বানাচ্ছেন শাহরার আহমেদ। ড্যাপারে এসেছিলেন স্যুট ঢিলা করতে। শাহরার বলেন, 'ড্যাপার ইজ এক্সিলেন্ট অ্যান্ড ফাইন। আমি এদের সুন্দর সার্ভিসের জন্যই এখানে কাপড় বানাতে আসি।'
সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ তার মুজিব কোটের ট্রায়াল দিতে ড্যাপারে এসেছিলেন। তিনি শুরু থেকেই ড্যাপারে বিভিন্ন ধরনের কাপড় বানাচ্ছেন। ড্যাপারে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, 'মূলত দু'জনের জন্য ড্যাপারে আসি। প্রথমজন শাহজামান সাহেব, দ্বিতীয়জন মাস্টার বাবুভাই। আমি সেই ইন্টারমিডিয়েট থেকে বাবু ভায়ের কাছে কাপড় বানাই।'
'এরা ফোকাসড এবং ডিটেইলড সার্ভিস দেয়। কাস্টমারের জ্বালাতন সহ্য করে নির্দ্বিধায়। আমি নিজে তো আসি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকেও এখানে নিয়ে আসি। ইটস ফাইন টেইলারিং।'
সেজান মজুমদার জানান মূলত ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট কর্মকর্তারাই ড্যাপারের নিয়মিত ক্রেতা। তিনি বলেন, 'ড্যাপারে একজন ব্যাংকের সিইওকে যেভাবে দেখা যায় কোনো অ্যাড ফার্মের ডিরেক্টরকে সেভাবে দেখা যায় না। এখন অবশ্য দিন বদলাচ্ছে। সবাই আসা শুরু করেছেন ড্যাপারে।'
জুয়েল রানা বলেন, 'সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে বেসরকারি কর্মকর্তাদের ড্যাপারে বেশি দেখা যায়। করোনার আগে সোনারগাঁও হোটেলের ব্রাঞ্চে অনেক বিদেশি বা প্রবাসীরা স্যুট বানাতে আসতেন। করোনার কারণে তাদের সংখ্যা কমে গেছে।'
সেজান মজুমদার কথায় কথায় একটি মজার তথ্য দেন। তিনি বলেন, 'সত্যি কথা বলতে আমাদের এখানে যারা আসেন তাদের ৯৫ শতাংশ লোকেরই বডি টাইপ ও পার্সোনালিটি অনুযায়ী ফ্যাশনের ব্যাপারে কোনো আইডিয়া থাকে না। আমরা কাস্টমারদের ব্যাপারে তাদের চেয়ে বেশি বলতে পারি। ইনিশিয়াল কনসালটেশনে তারা ইমপ্রেসড হয়।'
ড্যাপারে স্যুটের চাহিদা বেশি থাকার কারণে স্যুট মাস্টারের সংখ্যা বেশি। শার্টের মাস্টার মাত্র একজন। স্যুট ও প্যান্টের মাস্টার মোটামুটি চারজন। সেজান মজুমদার বলেন, 'আমাদের কারিগরেরা কাজ করতে করতে এখন যথেষ্ট দক্ষ। আগে স্যুটের ট্রায়ালের সময় আমাকে থাকতে হত। এখন ওরাই খুব ভালোভাবে সবকিছু করতে পারছে।'
'এর মানে এই নয় আমরা পারফেকশনের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছি। আমি এখনও তাদের কাছ থেকে শিখছি, আবার তারা আমার কাছ থেকে শিখছে।'
ড্যাপারকে নিয়ে সেজান মজুমদারের ভবিষ্যত পরিকল্পনাগুলো বেশ চমকপ্রদ। বর্তমানে কাস্টমমেড স্যুট বানালেও ভবিষ্যতে ড্যাপার 'রেডি টু ওয়্যার' স্যুট বানাতে চায়। এতে করে মেনজ বডির ধরনের আলোকে কয়েক সাইজের বা ধাঁচের স্যুট শোরুমে রাখা হবে, কাস্টমার ট্রায়াল দিয়ে মাপ অনুযায়ী স্যুট নিয়ে যাবেন।
শুধু স্যুটের ফিনিশিং করে কাস্টমারের হাতে তুলে দেওয়া হবে। বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানের মৌসুমে রেডি টু ওয়্যারের চাহিদা বেড়ে যায়। সাফারি জ্যাকেটের রেডি টু ওয়্যারে ভালো সাড়া পাওয়ার পরে সেজান এ বছরই স্যুটে রেডি টু ওয়্যার প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ক্রেতাদের মাঝে রেডি স্যুটের সাড়া দেখে আরেকটি শাখা খোলার ব্যাপারে ভাবা হবে।
ড্যাপারে মূলত পুরুষদের ফ্যাশন নিয়ে কাজ করা হলেও কখনো কখনো নারীদের কোট, শার্ট যে বানানো হয় না, তা কিন্তু নয়। তবে তা অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে।
এ প্রসঙ্গে সেজান মজুমদার জানান, 'আমরা এখনও মেনজ অ্যানাটমি নিয়ে যতটা জানি উইমেনস অ্যানাটমি নিয়ে ততটা জানি না। ভালোভাবে জানাশোনার পরে উইমেনস ফ্যাশন নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা আছে আমাদের।'