মার্কিন ফর্মুলায় দেশেই উৎপাদন হবে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ডায়াডিকের উদ্ভাবিত ফর্মুলা ও টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে দেশে করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে সরকার।
গোপালগঞ্জে অবস্থিত রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডে (ইডিসিএল) এই ভ্যাকসিন উৎপাদন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্যে ডায়াডিকের ফর্মুলা ও টেকনোলজি পেতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ), স্টিলের স্ট্রাকচারে ভ্যাকসিন প্লান্ট স্থাপন এবং জমি অধিগ্রহণ ও প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগুলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশে প্রোটিন ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু হতে পারে।
ভ্যাকসিন উৎপাদন বিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমেরিকার ডায়ডিক কোম্পানির সাথে আলোচনা চলছে, তারা যদি টেকনোলজি ট্রান্সফার করতে রাজি হয়, তাহলে সে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হবে। আর না হলে ভ্যাকসিন বাল্কে করে এনে ফিল ফিনিশ করা হবে।"
মার্কিন বায়োটেকনোলজি কোম্পানি ডায়াডিক ইন্টারন্যাশনাল ইঙ্ক ইতোমধ্যেই আফ্রিকায় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে। আফ্রিকাতেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম টিকা দেওয়া হয়েছে।
কোম্পানিটি চলতি বছরের জুলাই মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার রুবিক কনসোর্টিয়ামের সাথে টেকনোলজি ট্রান্সফার এবং লাইসেন্সিং চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ট্রায়ালের জন্য অনুমতি চাওয়া হবে।
দ্রুতই টেকনোলজি ট্রান্সফার শুরু হবে। অক্টোবর বা নভেম্বরের শুরুতেই ডায়াডিকের ট্রায়াল শুরু হতে পারে। ডায়াডিকের প্রযুক্তি পরে অন্যান্য টিকা তৈরিতে ব্যবহার করা হতে পারে।
এ বিষয়ে আলোচনার শুরুর পর ইডিসিএল আমেরিকার ডায়াডিক কোম্পানির সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে।
মহামারি ঠেকাতে সরকার শুরুতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কেনে, যা ভারতের সেরাম ইউন্সটিউটের উৎপাদিত।
তবে প্রথমে কয়েক দফা ভ্যাকসিন পেলেও করোনার প্রকোপ ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করে। তারপর ফাইজার, মর্ডানা ও সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে।
মহামারির মোকাবিলায় নিজেদের দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার।
আর এই আলোচনার পর ভ্যাকসিন উৎপাদনে ডায়াডিকের ফর্মুলা ও টেকনোলজি ট্রান্সফারের বিষয়ে বেশি এগিয়েছে বাংলাদেশ।
ভ্যাকসিন তৈরিরর জন্য ডায়াডিকের সঙ্গে সাথে কাঁচামাল ও টেকোনলজি ট্রান্সফারের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চুক্তি হবে। এ বিষয়ে একটি খসড়া এমওইউ তৈরি করা হয়েছে। তবে সরকারের নির্দেশনার পরই সমঝোতাটি স্মারক স্বাক্ষরিত হবে।
এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এহসানুল কবির জগলুল টিবিএসকে বলেন,
"ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়ে ডায়াডিক কোম্পানির সাথে আলোচনা হয়েছে, সেখানে বিভিন্ন ডকুমেন্টস এক্সচেঞ্জ করেছি।"
"ডায়াডিক একটি এমওইউ করতে চায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির অনুমতি পেলে ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়ে সেটি করা হবে। এমওইউ-এর প্রক্রিয়া চলছে।"
এমওইউ না করলে তাদের অন্য কোথাও চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে জানান তিনি।
ডায়াডিক ছাড়াও রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত প্রোটিন ভ্যাকসিন তৈরীর আলোচনাও চলছে বলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জানানো হয়।
গত ১৩ অক্টোবর ওই বৈঠকে আলোচনার পর দেশে দ্রুত ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দ্রুত বাস্তবায়নে সুপারিশ করা হয়েছে।
ওই বৈঠকে জানানো হয়, বিশেষজ্ঞের পরামর্শক্রমে করোনার ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্যে মূল যন্ত্রপাতি ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপান এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হবে।
যার জন্য বিভিন্ন বিদেশি যন্ত্রপাতি উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে প্রাক্কলিত দরও তৈরী করা হয়েছে।
ভ্যাকসিন উৎপাদনে কারিগরি কমিটি ও সুপারিশ
কার্যকর ও নিরাপদ ভ্যাকসিন উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ ও এ সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ পর্যালোচনা করে সরকারের নিকট সুপারিশ প্রদান এবং ভ্যাকসিন উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা গ্রহণে ৯ সদস্যবিশিষ্ট কোভিড-১৯ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন উৎপাদন কারিগরি কমিটি গঠন করে সরকার।
চলতি বছরের ১২ জুলাই এই কমিটি গঠনের পর পাঁচটি সভা করে ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেছে।
কমিটি সূত্রে জানা যায়, ভ্যাকসিন উৎপাদনে কারিগরি কমিটির একটি সুপারিশ ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ডায়াডিকের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন ফর্মুলায় কার্যকারতার হার ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্ণয়ে দেশে ট্রায়ালের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
কারণ তারা ফর্মুলা উদ্ভাবন করলেও ট্রায়াল সম্পন্ন করতে পারেনি। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে এমন শর্তে ট্রায়ালের অনুমতি দিলে দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা যেতে পারে।
কারণ এখন পর্যন্ত যারা ভ্যাকসিনের ফর্মুলা আবিষ্কার করেছে, তা সহজে পাওয়া যাবে না।
এছাড়াও করোনার ভ্যাকসিনের বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদার কারণে ভ্যাকসিনের কাঁচামালেরও সংকট রয়েছে। তবে ডায়াডিকের প্রোটিন ভ্যাকসিন উৎপাদনে কাঁচামালের তেমন সংকট হবে না।
কারিগরি কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন ড. আব্দুর রহমান টিবিএসকে বলেন, ডায়াডিককে দেশে ক্লিনিকাল ট্রায়াল করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে, যার বিপরীতে ভ্যাকসিনের ফর্মূলাসহ অন্যান্য সেট-আপ স্থাপনে তারা সহায়তা করবে- এমন সুপারিশ করা হয়।"
তিনি বলেন, "এটা করা গেলে তারাও সুবিধা পাবে, আমরাও দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিনের ফর্মুলা পাবো। প্রোটিন ভ্যাকসিনের একটা বড় সুবিধা আছে, এটার জন্য কাঁচামালের কোনো সংকট হবে না। যদিও বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদার কারণে অন্যান্য ভ্যাকসিনের কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে।"
এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানির অবকাঠামো উন্নয়ন
রাষ্ট্রায়াত্ত্ব এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে সরকার ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ নিলেও পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই।
কোম্পানিটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ১৯৬২ সালে কোম্পানিটি তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সরকারি ফার্মাসিউটিক্যালস ল্যাবরেটরির (জিপিএল) অধীনে পরিচালিত হতো। পরবর্তীকালে ১৯৭৯ সালে ফার্মাসিউটিক্যালস প্রোডাকশন ইউনিট (পিপিইউ) নামে নামকরণ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ।
তবে অতি পুরনো এই ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিটিতে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও আধুনিক ল্যাবরেটরি নেই। আবার বিদ্যামান অবকাঠামোতেও ভ্যাকসিন উৎপাদন সম্ভব নয়।
তবে ভ্যাকসিন উৎপাদনে সরকার ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়ায় অবকাঠামো উন্নয়নের জটিলতা দূর হয়েছে।
অবকাঠামো নির্মাণের অংশ হিসাবে ভবন নির্মাণ সময়সাপেক্ষ হওয়ায় স্টিলের স্ট্রাকচারে ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যার জন্য এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানির পাশে ৮ একর জয়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যাতে স্টিলের অবকাঠামোর উপর ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রয়োজনীয় ল্যাব নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি বসানো হবে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ২-৮ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট-এর কোল্ডরুম এবং কুলরুম নির্মাণের মাধ্যমে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা হবে।
অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, "ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য ৯০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের কাজ হয়ে গেছে, বাকী ১০ শতাংশ অধিগ্রহণের কাজ এ মাসে হয়ে যাবে।"
"দ্রুততম সময়ে উৎপাদনে যাওয়ার জন্য সেখানে স্ট্রিলের স্ট্রাকচার তৈরি করা হবে। কনসালটেন্ট ও একজন বিজ্ঞানী নিয়োগের বিষয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।"