রাশিয়া ও চীনের টিকা তৈরি হবে দেশে
আগাম মূল্য পরিশোধের পরও প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে ভ্যাকসিন না পাওয়ায় ৯ মাস পর আবারও চীনা ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, চাহিদা মেটাতে চীনা ভ্যাকসিনের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। তাই রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি এর পাশাপাশি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের ভ্যাকসিনও দেশে উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
সিনোফার্মের টিকা বাংলাদেশে উৎপাদনের আগ্রহে চীন সরকারের সম্মতি পাওয়ার পর বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এ দুই দেশের টিকা উৎপাদনের প্রস্তাব নীতিগত অনুমোদন করেছে।
বুধবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, 'সিনোফার্মের ভ্যাকসিন উৎপাদন বিষয়ে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করা হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে চীনা কোম্পানিটির সঙ্গে আমাদের চুক্তি হবে। আর রাশিয়ার সঙ্গে আগেই চুক্তি হয়েছে'।
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের জন্য বেক্সিমকো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সরকারকে তাগিদ দিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
গতবছর জুলাই মাসে চীনের সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল দেওয়ার আগ্রহ নিয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল তা অনুমোদন করার পর আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ট্রায়ালের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
ওই সময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ঝটিকা সফরের পর চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে বাংলাদেশের আগ্রহ কমে যায় এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন কেনার উদ্যোগ নেয় সরকার। ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ভ্যাকসিনের সংকট কাটাতে গত দু'সপ্তাহ ধরে চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিনের জন্য তৎপরতা বাড়ায় সরকার।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল প্রত্যাখ্যান করে একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল হওয়া ঠিক হয়নি। সময়মত চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হলে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে অনেক আগেই বাংলাদেশে চীনা ভ্যাকসিন উৎপাদন সম্ভব হতো।
তারা বলছেন, দেরিতে হলেও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার বাইরে অন্য উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ একটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হলে সেখানে যেন সরকারের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব থাকে।
বেসরকারি খাতের ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিটিক্যালস এর ভ্যাকসিন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে সক্ষমতা বাড়ানোসহ আধুনিকায়ন করলে ভ্যাকসিন উৎপাদন সম্ভব হবে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'চীনা ও রাশিয়ান ভ্যাকসিন উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হলো। একইসঙ্গে, আমরা আমাদের ভ্যাকসিনের প্রাথমিক উৎস সেরাম ইনস্টিটিউট থেকেও ভ্যাকসিন পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবো'।
সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. সাহিদা আক্তার বলেন, 'সরকারের কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে'।
'প্রস্তাবনা পেশ করার পরই ভ্যাকসিন উৎপাদনের খরচ সম্পর্কে জানা যাবে', যোগ করেন তিনি।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'চীন তাদের ভ্যাকসিন বাংলাদেশে উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে। যত শীঘ্র সম্ভব উৎপাদন শুরু হবে'।
সভায় ঠিকাদার ছাড়াই সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে পিপিই, মাস্ক, পিসিআর কিট কেনার অনুমোদনও দেওয়া হয়।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান গত মঙ্গলবার জানান দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিনের উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
রাশিয়ার উদ্ভাবিত করোনার টিকা স্পুটনিক-ভি এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী মাসে ৪০ লাখ টিকা আমদানির পাশাপাশি দেশেই ওই টিকা উৎপাদনের জন্য তোড়জোর করছে সরকার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'টিকা প্রদান পুরোদমে সচল থাকলে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা, রোগী ও মৃত্যু কমে যাবে। ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রযুক্তি হস্তান্তর বা যে কোন কিছুতে সরকারের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব স্পষ্ট থাকতে হবে'।
'রাষ্ট্রের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ না থাকার কারণে আমরা প্রথমবারে ভ্যাকসিন সংকটে পড়লাম। তাই দ্বিতীয়বার ভ্যাকসিন সংগ্রহের সময় যেন আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়', যোগ করেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক বলেন, 'দেরিতে হলেও চীন-রাশিয়ার ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা সরকারের একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। তবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়টি শুধু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর ছেড়ে দেয়া যাবে না। এজন্য সরকারি সক্ষমতাও বাড়াতে হবে'।
সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ করোনা ভাইরাসের টিকা কিনতে গত বছরের ৫ই নভেম্বরে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে ছয় মাসে ৩ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের।
চুক্তি অনুযায়ী, সেরাম ইনস্টিটিউটের তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের মধ্যে এখন পর্যন্ত দুই দফা চালানে ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ।
এরইমধ্যে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া বন্ধ করা হয়েছে। প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নেয়া ১৩ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। সবাইকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দিতে ভারতের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। তবে কবে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি এখনো।