সাড়ে ৭ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর মানবেতর জীবন
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সৃষ্ট লকডাউন এবং সরকার ঘোষিত দীর্ঘ ছুটির কারণে গত কয়েক মাস ধরে বেতনভাতা পাচ্ছেন না লক্ষ্মীপুরের প্রাইভেট ও নন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। জেলার এমন ৭০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষক-কর্মচারীরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
সম্মানীয় পেশায় থাকার কারণে শিক্ষকরা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণও নিতে পারছে না। আবার কোনো ধরনের সহায়তার তালিকায়ও তাদের নাম নেই। অস্বচ্ছল শিক্ষক পরিবারের সহায়তায় এখন পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা।
মঙ্গলবার লক্ষ্মীপুর জেলার প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং নন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষক নেতারা মোবাইল ফোনে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এমন তথ্য জানিয়েছেন।
মো. জামান (ছদ্মনাম) ছিলেন গরিব ঘরের মেধাবী সন্তান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে অর্জন করেছেনে সর্বোচ্চ ডিগ্রী। সরকারি চাকরি খুঁজতে খুজঁতে বয়স পার। বর্তমানে জেলার কমলনগর উপজেলার গ্লোবাল স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা করছেন। কোনও মতে পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চালাচ্ছিলেন। কিন্ত গত দুই মাস প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন নেই। ওই বেতনের উপরই নির্ভর করে জীবন চালান তিনি।
''সংসার চলছে না, এমন অভাব আগে কখনও দেখিনি। বাইরে গিয়ে ত্রাণ চাওয়াটাই বাকি রয়েছে, কিন্ত সেটাও পারছি না'', বললেন জামান।
জেলার চর লরে গ্লোবাল স্কুল এন্ড কলেজের সভাপতি হুমায়ুন কবির জানান, শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফি'র টাকা থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসিক বেতনভাতা পরিশোধ করা হয়। কিন্ত মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ।
''শিক্ষক-কর্মচারীরা গত মার্চ, এপ্রিল মাসের বেতন পাননি। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ফেব্রুয়ারি মাসেরও বেতন পাননি। সামনে আর কত দিন এভাবে চলবে বলা যাচ্ছে না।'' শিক্ষকরা চলবে কিভাবে? প্রশ্ন রাখেন তিনি।
স্থানীয় তোরাবগঞ্জ অগ্রণী স্কুলের উদ্যোক্তা সফিক উল্লাহ জানান, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের ভবন ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
জেলার সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রাইভেট স্কুল রায়পুর কাজী ফারুকী স্কুল এন্ড কলেজের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মার্চ মাসে মালিক অর্ধেক বেতন দিয়েছে। এখনও এপ্রিল বাকী। পরিবার নিয়ে কত কষ্টে আছি বুঝাতে পারবো না। এবার ঈদ করা যাবে না।
লক্ষ্মীপুর শহরের একটি প্রাইভেট মাদরাসার শিক্ষক মো. হোসেন জানান, মা, তিন সন্তান এবং স্ত্রী নিয়ে সামান্য বেতনে শহরের একটি বাসায় ভাড়া থাকি। শিক্ষকতা আর টিউশনিতে চলতো সংসার।
''এখন প্রতিষ্ঠানের বেতন এবং টিউশনি সবই বন্ধ। বাসা ভাড়া, সংসার খরচ, মায়ের ওষুধ খরচ কিছু নেই। আমাদের কথা কেউ ভাবে না।''
লক্ষ্মীপুর প্রাইভেট স্কুলগুলোর সংগঠন 'ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অফ লক্ষ্মীপুর প্রাইভেট স্কুল' এর সভাপতি আবদুর রহমান জানান, স্কুল বন্ধ থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশন ফি বন্ধ। গত দুই-তিন মাস ধরে শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছি না। শিক্ষক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
লক্ষ্মীপুর জেলা নন এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন জানান, প্রতিষ্ঠানগুলো যে দিনই খোলা হোক না কেন, একদিনও না পড়ে শিক্ষার্থীরা বেতনভাতা পরিশোধ করবে না।
''আবার স্কুল খোলার সঙ্গে সঙ্গেই যে সবাই বেতন পরিশোধ করবে ব্যাপারটা তা-ও নয়। কারণ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বিভিন্ন পেশাজীবীর। তারাও এখন বেকার রয়েছেন। কমপক্ষে আগামী ছয় মাস শিক্ষক সমাজ চরম অভাবে থাকবে।''
তিনি প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং স্বচ্ছল অভিভাবকদেরকে শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
শিক্ষকদের এমন দুঃসময়ের বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল মতিন জানান, বিষয়টি আমি উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ বরাবর জানাবো।
অন্যদিকে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান অসহায় শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক তালিকা প্রনয়ণ করে আবেদন করার জন্য পরার্মশ দেন। তিনি আরো জানান, সরকার কোনও অস্বচ্ছল ব্যক্তিকেই সহায়তার বাহিরে রাখবে না। তবে বিষয়টি প্রশাসনকে জানাতে হবে।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাইভেট স্কুলগুলোর সংগঠন এবং জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে প্রাইভেট এবং ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬৯২টি। এগুলোর মধ্যে কিন্ডারগার্টেন এবং প্রাইভেট স্কুল, কলেজ, মাদরাসার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬শ। ননএমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২৯টি এবং ননএমপিও মাদরসা ৬৩টি। এ সকল প্রতিষ্ঠানে প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন।