স্কুলে উপস্থিতির হার কমছে, তবু কর্তৃপক্ষের আস্থা ‘ধীরে চলো’ নীতিতে
গত ১২ সেপ্টেম্বর যখন প্রায় দেড় বছরের করোনাকালীন বন্ধ শেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীরে পাঠদান শুরু হলো, তখন প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দেশব্যপী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার ছিল ৬৭ শতাংশ।
আশা করা হচ্ছিল, উপস্থিতির এই হার হয়তো ধীরে ধীরে বাড়বে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর প্রথম তিন সপ্তাহের যে পরিসংখ্যান, তা একদমই আশাজাগানিয়া নয়। প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হার একটু একটু করে কমেছে, এবং গত ২৮ সেপ্টেম্বর তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশে।
মহামারি চলাকালীন দেশব্যাপী স্কুল-কলেজগুলোতে উপস্থিতির হার ক্রমান্বয়ে হ্রাসের যে প্রবণতা, তা রোধ করার জন্য অতিসত্ত্বর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, এমনটিই মত শিক্ষাবিদদের।
তবে সরকার এক্ষেত্রে 'ধীরে চলো' নীতি অবলম্বন করছে, চাইছে আরেকটু অপেক্ষা করতে।
'শিক্ষার্থী বা তাদের পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ থাকতে পারে, তাই আমরা কাউকেই ক্লাসে যোগ দেয়ার ব্যাপারে জোর করছি না। আমার মনে হয় আগামী দিনগুলোতে উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পাবে,' বলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্কুলে উপস্থিতি বৃদ্ধির জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণের কথা ভাবছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বর্তমানে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
স্কুলে অনুপস্থিতি বৃদ্ধির পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে উল্লেখ করলেও তিনি জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয় এখনো প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করার জন্য কোনো ধরনের গবেষণা পরিচালনা করেনি।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত সমাধানের পথ খোঁজার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানোর জন্য আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। তা না-হলে ঝরে পড়ার হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে এবং লার্নিং লসের (শিখন ক্ষতি) পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে শিক্ষা খাতে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে বলে তিনি সতর্ক করে দেন।
'শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন পর খুলেছে। অনেক শিক্ষার্থীই এ সময়ের মধ্যে নতুন জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। কেউ কেউ আবার চাকরিতে যুক্ত হয়েছে, এবং অনেক নারী শিক্ষার্থীকেই বাল্য বিয়েতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ধরনের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে,' বলেন অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুরোদমে ক্লাস শুরু করা, কেননা ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী কোভিড-১৯ সংক্রমণের হাত ৩ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
বর্তমানে সংক্ষিপ্ত রুটিনে ক্লাস পরিচালিত হচ্ছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কেবল মহামারি নিয়ন্ত্রণে চলে এলেই চিরাচরিত রুটিনে ক্লাস শুরু করা হবে।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলাম সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এলে ক্লাস শুরু করতে। এখন যেহেতু সংক্রমণের হার কমে এসেছে, সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে সশরীরে ক্লাস চালু রাখতে পারে।'
'শিক্ষার্থীরা লার্নিং লসে ভুগছে, এবং তাদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যেই ঝরে পড়েছে। সুতরাং সরকারের উচিত না যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে আর এক দণ্ডও দেরি করা।'
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে পাওয়া উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, অনুপস্থিতির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা।
এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হারও অত্যন্ত হতাশাজনক।
ঝরে পড়ার দ্বারপ্রান্তে ২৫ লাখ শিক্ষার্থী
প্রায় ১৫,০০০ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মহামারি চলাকালীন স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে ২৫ লাখের মতো শিক্ষার্থীর উপর নেমে এসেছে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার ছায়া।
কয়েকটি স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে টিবিএস জানতে পেরেছে, স্কুল কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালাচ্ছিল তাদের সকল শিক্ষার্থীকে স্কুলে ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যেই নিজেদের ও পরিবারের জীবিকার সন্ধানে চাকরিতে নেমে পড়েছিল, এবং তারা চাইছিল না পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। শিক্ষকরা আরো জানান, অনেক শিক্ষার্থীই অন্য কোথাও চলে গেছে।
কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের প্রেসিডেন্ট এম ইকবাল বাহার চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, মহামারির পূর্বে ১ কোটি শিক্ষার্থী ও ১০ লাখ শিক্ষক নিয়ে ৬০,০০০ কিন্ডারগার্টেন চালু ছিল।
'মাত্র ৪৫,০০০ কিন্ডারগার্টেন পুনরায় ক্লাস শুরু করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু সেগুলোতেও এখন দৈনিক উপস্থিতির হার মাত্র ৬০ শতাংশের মতো। অথচ মহামারি-পূর্ব সময়ে নিয়মিত উপস্থিতির হার ছিল গড়ে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ।'
লার্নিং লস মূল্যায়নে কাজ করছে মন্ত্রণালয়
মহামারি চলাকালীন লার্নিং লস খতিয়ে দেখতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) একটি কমিটি গঠন করেছে বলে জানান এর কর্মকর্তারা। তারা আরও বলেন, এ ধরনের ক্ষতির মাত্রা ঠিক কতটা তা নিরূপণের পর মন্ত্রণালয় নতুন করে পাঠ্যসূচি তৈরি করবে।
মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, গঠিত কমিটি ২ সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।
'এই প্রতিবেদনটি হাতে পাওয়ার পর আমরা লার্নিং লসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারব,' বলেন তিনি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, এর আগে তাঁর বোর্ড একটি রেমেডিয়াল (প্রতিকারমূলক) প্যাকেজ চালু করেছিল শিক্ষার্থীদের লার্নিং লসের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য, কিন্তু স্কুল খুলতে অনেক দেরি হয়ে যাওয়ায় তাদেরকে এখন আরেকটি প্যাকেজ তৈরি করতে হবে।
'এ ব্যাপারে আমরা অনেক কিছুই করেছি, তাই আমরা খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই রেমেডিয়াল প্যাকেজটি তৈরি করে দিতে পারব,' তিনি যোগ করেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমি গত মে মাসে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেখানে পরামর্শ দিয়েছিলাম জেলা ও উপজেলা ভিত্তিক কমিটি গঠনের, যেখানে সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এটা করলে তারা স্কুলে ঝরে পড়ার হার রোধ এবং লার্নিং লসের পরিমাণ আন্দাজ করতে পারত।'
'এ বছর অনেক শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছে এসব ইস্যু নিয়ে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নেই।'
- প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে পড়ুন: School attendance continues to drop, yet authorities stick to 'wait-and-watch' policy