অবসর-সুবিধা পাওয়ার আশায় দিন গুনছেন ৫৩ হাজার বেসরকারি শিক্ষক
কুমিল্লা জেলার বরুড়ার শাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাঈম উদ্দিন আহমেদ ২০২১ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের মাধ্যমে কাজের চাপমুক্ত স্বস্তির জীবন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও– নাঈম উদ্দিনের জীবনে হঠাৎ করেই নেমে আসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ। অবসরে যাওয়ায় কিছুদিন পরেই তিনি জানতে পারেন, ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে তার শরীরে।
ক্যান্সারের ব্যয়বহুল চিকিৎসার ভার সামলাতে নিজের সমস্ত সম্পদ বিক্রি এবং সঞ্চয় ভাঙাতে বাধ্য হন নাঈম উদ্দিন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ঢাকার ডেল্টা হাসপাতালে। তার দুই সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
অবসরপ্রাপ্ত এই প্রধান শিক্ষকের বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড (এনজিটিইডব্লিউটি) এবং বেসরকারি কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড (এনজিইআরবিবি)-এর কাছ থেকে অবসর সুবিধা পাওয়া ছাড়া আয়ের আর কোনো উৎস অবশিষ্ট নেই। তাই ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার খরচ এবং চিকিৎসা খরচ সামলে নিতে তিনি নিজের কর্মজীবন পরবর্তী অবসর সুবিধা পাওয়ার আশায় রয়েছেন।
তবে অবসরে যাওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও, নাঈম উদ্দিন এখনও একটি টাকাও পাননি।
"আমি খুব কষ্টে জীবনযাপন করছি। সন্তানদের কোনো টাকা দিতে পারি না, এমনকি আমার পরিবারের খরচও চালাতে পারি না। আমি আমার বর্তমান পরিস্থিতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না," কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন নাঈম উদ্দিন।
"অবসরে যাওয়ার পরপরই অবসরকালীন সকল সুবিধা পাওয়া আমার অধিকার। কিন্তু কেন দেরি হচ্ছে? আমি কষ্টে আছি, আর আমি চাই না অন্য শিক্ষকরাও আমার মতো কষ্ট করুক," যোগ করেন তিনি।
নাঈম উদ্দিনের ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রায় ৫৩ হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে তাদের অবসরকালীন সুবিধা পেতে মুহূর্ত গুনছেন।
অবসর গ্রহণের পরপরই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এ সুবিধা পাওয়ার কথা। চাকরিতে থাকালীন কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে, তার পরিবারের সদস্যদের অনতিবিলম্বে এ সুবিধা দেওয়ার কথা।
কিন্তু, বাস্তবে তা হচ্ছে না। অবসরপ্রাপ্ত কারো সময়মতো অবসরভাতার সুবিধা পাওয়ার রেকর্ডও নেই।
আ হ ম শফিউল্লাহ হাজারীও এক বছর ধরে ক্যান্সারে ভুগছেন। টাকার অভাবে তিনি চিকিৎসা চালাতে পারছেন না। চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত পরবর্তী ধাপের চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু দরিদ্র স্কুল শিক্ষক তার একমাত্র অর্থের উৎসের দিকে তাকিয়ে আছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের সুবিধা বুঝে পেতে তিনি এনজিইআরবিবি-তে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু, আজো কিছুই পাননি।
"আমি কষ্টে আছি এবং আমার চিকিৎসা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আমি গত ৩৫ বছর ধরে ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়তে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু আমি এখন অসহায়, চরম কষ্টের সময় পার করছি," বলেন তিনি।
এনজিইআরবিবি'র সদস্য সচিব শরীফ আহমেদ সাদি টিবিএসকে জানান, অবসর বোর্ডের জন্য সরকার পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়নি।
তিনি বলেন, "আসলে এটি আমাদের জন্যও খুব বেদনাদায়ক, যখন একজন শিক্ষক আমার কাছে এসে কাঁদেন। মূলত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা অসহায়। আমরা সময়মতো শিক্ষকদের অবসর সুবিধা প্রদানের জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছি, কিন্তু এখনও কোনো অগ্রগতি হয়নি।"
"আমার দায়িত্ব শুধু এখানে তহবিল বিতরণ করা। সরকার আমাকে তহবিল না দিলে আমি কিছুই করতে পারব না," যোগ করেন তিনি।
এনজিইআরবিবি-তে মোট ৩১ হাজার আবেদন স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। এসব আবেদনকারীকে অর্থ প্রদানের জন্য অবসর বোর্ডের প্রয়োজন কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা।
জানা যায়, ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত যেসব শিক্ষাকরা আবেদন করেছিলেন, এপর্যন্ত তাদের অর্থ প্রদান করেছে অবসর বোর্ড।
অবসর সুবিধা বোর্ডের কর্মকর্তা মারুফ হোসেন জানান, অবসরকালীন সুবিধার চেক প্রক্রিয়া হতে সময় লাগার কথা প্রায় তিনমাস।
"দুর্ভাগ্যবশত, এখন এতে সময় লাগে প্রায় তিন বছর," যোগ করেন তিনি।
এনজিইআরবিবি সূত্র জানায়, অবসর বোর্ড শিক্ষকদের মূল বেতন থেকে ৬ শতাংশ কেটে, প্রতি মাসে শিক্ষকদের কাছ থেকে ৬৫ কোটি টাকা পায়। কিন্তু, প্রতি মাসে বোর্ডের প্রয়োজন হয় ১০০ কোটি টাকা। তহবিল তৈরি হওয়ার পর এ পর্যন্ত বোর্ড ১ লাখ ৬৫ হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে ৫ হাজার কোটি টাকা অবসর সুবিধা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অবসর সুবিধা পেতে ২২ হাজার আবেদন এখনও ঝুলে আছে। এটি মেটাতে কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন বোর্ডের। বোর্ড এখন ২০২০ সালের আগস্টে আবেদনকারী শিক্ষক ও কর্মচারীদের অর্থ প্রদান করছে।
বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু টিবিএসকে বলেন, তারা একটি বিশেষ তহবিল পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন।
"আমরা সংকট সমাধানের চেষ্টা করছি। আমি মনে করি আমরা শীঘ্রই এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাব," বলেন তিনি।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, "অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দুর্ভোগের বিষয়টি সত্য। তবে এটি বেশিদিন স্থায়ী হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেব।"
প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী মাসিক বেতন আদেশের অধীনে প্রায় ২৮ হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
১৯৯০ সালে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে সরকার, কিন্তু ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এর কার্যক্রম স্থগিত ছিল। তবে, ১৯৯৭ সালে আবারও এর কার্যক্রম শুরু হয়।
সুবিধা পেতে ঘুষের দেওয়ার অভিযোগ!
এনজিইআরবিবি এবং এনজিটিইডব্লিউবি উভয় বোর্ডের কিছু কর্মকর্তা ঘুষ গ্রহণ ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘুষ নিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই তারা অবসর সুবিধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন অনেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক টিবিএসকে বলেন, অবসরের সুবিধা পেতে তাকে মাত্র ৬ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং সেজন্য তিনি ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন।
তবে অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু ঘুষের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তার বোর্ডের কল্যাণ তহবিল বণ্টন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছ।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সুবিধা পেতে এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, সরকারকে অবিলম্বে এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ড. সিদ্দিকুর রহমান টিবিএসকে বলেন, শিক্ষকরা সময়মতো তাদের সুবিধা পান না এবং বিনা চিকিৎসায় মারা যান, এটি জাতির জন্য লজ্জাজনক।
এ ধরনের ঘটনা বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহীদের নিরুৎসাহিত করে। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায়, অবসর তহবিলের বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।