প্লাজমা-বেজড ওষুধে ৫,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে সিনোভ্যাক
বাংলাদেশে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে প্লাজমা-বেজড ওষুধ উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে কোভিডের টিকা তৈরি করা চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক বায়োটেক।
ওষুধটি বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে সিনোভ্যাক বায়োটেক (বাংলাদেশ) লিমিটেড নামে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়েছে।
একইসঙ্গে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গেও যৌথভাবে কোভিডের টিকা উৎপাদন করবে প্রতিষ্ঠানটি। এ-সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারকও (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে।
আগামী বছরের মার্চ বা এপ্রিল নাগাদ প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানবদেহের রক্ত থেকে প্লাজমা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রক্রিয়ায় রক্তের প্লাজমাকে তার বিভিন্ন উপাদানে আলাদা করে তা থেকে ওষুধ তৈরি করা হয়। আশা করা হচ্ছে, এসব প্লাজমা থেকে প্রায় ৮ ধরনের ওষুধ তৈরি করবে প্রতিষ্ঠানটি।
সিনোভ্যাক বায়োটেক (বাংলাদেশ) লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক কেভিন ঝাং দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্লাজমা-বেজড ওষুধ তৈরি ও উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্গেটেড দেশগুলোর একটি হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশে আসার আগে আমরা দক্ষিণ আমেরিকা, চিলি, কলম্বিয়া ও তুরস্কে কয়েকটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরও শাখা স্থাপনের পরিকল্পনা করছি।'
তিনি জানান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডও শাখা স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
ঝাং বলেন, 'প্রতি বছর সরকারকে প্লাজমা পণ্য আমদানি করতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। বাংলাদেশে প্লাজমা-বেজড পণ্যের শতভাগ আমদানি করা হয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মতো বেশির ভাগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর এ ধরনের পণ্য তৈরির সক্ষমতা ও সামর্থ্য নেই।
'আমরা বুঝেছি যে, চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা এবং সামর্থ্য দুটোই বাংলাদেশের যথেষ্ট আছে। এ কারণেই আমরা এখানে একটি ব্র্যান্ড গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
তিনি আরও জানান, প্রথম ধাপের তিন বছর ছাড়াও আগামী বছরগুলোতে আরও বিনিয়োগ করা হবে।
ঝাং বলেন, এই বিনিয়োগ প্লাজমা শিল্পে স্থানীয় দক্ষতা বৃদ্ধি করবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় ও তৈরি করবে, স্থানীয় রোগীদের প্লাজমা কেনার খরচ কমাবে এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মো. আসাদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে একজনের শরীরের কার্যকর অ্যান্টিবডি অন্যদের শরীরের স্থানান্তর করা হয়।
প্লাজমায় অনেক ধরনের অ্যান্টিবডি থাকে। কেউ যখন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়, তখন সেই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এ ধরনের অ্যান্টিবডি প্রোটিন তৈরি হয়।
ওই প্রোটিন জীবাণুর চারপাশে এক ধরনের আবরণ তৈরি করে সেটিকে অকেজো করে ফেলে। এভাবেই অ্যান্টিবডি কাজ করে বলে জানান ডা. আসাদুল।
এই গবেষক বলেন, দেশে বড় চাহিদা থাকলেও প্লাজমা-বেজড সব ওষুধই আমদানি করতে হয়। এসব ওষুধের কোনোটিই বাংলাদেশে উৎপাদন হয় না।
ওষুধ আমদানিকারকরা জানান, প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে ২ হাজার কোটি টাকার প্লাজমা-বেজড ওষুধ আমদানি করা হয়।
এসবের মধ্যে রয়েছে ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি, অটোইমিউন ইনফেকশন ও ইডিওপ্যাথিক রোগের ওষুধ।
কোভিড-১৯, ইনফ্লুয়েঞ্জা, পা ও মুখের রোগ, এইচআইভি এবং ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্যও প্লাজমা-বেজড ওষুধ প্রয়োজন।
'একটি প্লাজমা পৃথকীকরণ কেন্দ্র খুব প্রয়োজন। কারণ প্লাজমার বিভিন্ন উপাদা—অ্যালবিউমিন, গ্লোবুলিন ইত্যাদি—ক্যান্সার, লিভারের রোগসহ আরও কিছু রোগের চিকিৎসায় লাগে। আমরা যদি এই সক্ষমতা অর্জন করতে পারি—বায়োলজিক্যাল সেপারেশন—এবং সেগুলো বাজারজাত করতে পারি, তবে আমাদের শুধু আমদানির উপর নির্ভর করে থাকতে হবে না,' সম্প্রতি টিবিএসেরসঙ্গে এক আলাপচারিতায় জানিয়েছিলেন বায়োমেডিকেল বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক লিয়াকত আলী।
অ্যালবিউমিনের প্রায় ৭৫ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত হয়, বাকি ২৫ শতাংশ বিশ্বের অন্যান্য অংশে উৎপাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র দেশের বাইরে অ্যালবিউমিন রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে বিশ্বে অ্যালবিউমিন সংকট দেখা দেবে। তাই প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব দেশে প্লাজমা উৎপাদন কেন্দ্র তৈরির চেষ্টা করছে বলে জানান শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক। ডা. আশরাফুল কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশের প্রথম প্লাজমা ব্যাংক স্থাপন করেন।
প্লাজমা থেকে তৈরি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের মধ্যে রয়েছে ইমিউনোগ্লোবুলিন-ভিএফ (নবজাতকের হেমোলাইটিক রোগ প্রতিরোধ করা ও আরএইচ-নেগেটিভ গর্ভবতী মায়েদের জন্য), ইন্ট্রামাসকুলার ইমিউনোগ্লোবুলিন (হেপাটাইটিস এ, হাম ও পোলিওমাইলাইটিসের বিরুদ্ধে ইমিউনাইজেশন), 'অ্যালবিউমিন' (রক্তক্ষরণের কারণে শকে চলে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য।), ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবুলিন আইভিআইজি (কিছু প্রাথমিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ঘাটতিজনিত রোগের জন্য), অ্যান্টিথ্রোমবিন কনসেন্ট্রেট (সার্জারি বা প্রসবের সময় রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করতে) এবং ফ্যাক্টর আইএক্স কনসেনট্রেট (উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ব্লিডিং কন্ডিশন হিমোফিলিয়া বি রোগীদের চিকিৎসার জন্য)।
এই গবেষক বলেন, এসব ওষুধের সবই আমদানি করতে হয়।
কোভিড শুরুর পর দেশে সরাসরি প্লাজমা সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে চিকৎসা দেওয়া হলেও প্লাজমা-বেজড কোনো ওষুধ বাংলাদেশে উৎপাদন হয় না। যদিও এর বড় চাহিদা আছে দেশে।
প্লাজমা-বেজড ওষুধের বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার আগে এ বিষয়ে গবেষণা ও মূল্যায়ন থাকার দরকার বলে মন্তব্য করেন আসাদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, কোনো দেশি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে প্লাজমা সংগ্রহ, সরবরাহ বা আমদানি-রপ্তানি করতে চাইলে দেশের নির্ধারিত আইন মেনে করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ মনিটরিং থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই বিশেষজ্ঞ।
এছাড়া কোভিড টিকার উৎপাদন বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে, কারণ তখন আর দেশকে টিকার জন্য অনুদানের ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে না।
কাঁচামাল আমদানি করে সিনোভ্যাককে দেওয়া হবে, প্রতিষ্ঠানটি টিকা তৈরি করবে।
বিডায় জমা দেওয়া সিনোভ্যাক বায়োটেক (বাংলাদেশ) লিমিটেডের প্রস্তাব থেকে জানা যায়, আগামী বছরের শুরুর দিকে সারা দেশে অন্তত ২০টি প্লাজমা ব্যাংক ও কোল্ড স্টোরেজ রুম নির্মাণ করবে তারা।
২০ জেলায় প্লাজমা ব্যাংক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। সবগুলো ব্যাংকই ইউরোপীয় মানদণ্ড অনুসারে তৈরি হবে।
বছরে ৩০-৫০ টন প্লাজমা-বেজড পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০২৫ সাল নাগাদ প্লাজমা-বেজড ওষুধ তৈরির কাজ শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২৬ সালে বাণিজ্যিকভাবে প্লাজমা-বেজড ওষুধ বাজারজাত শুরু করবে।
ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন, বিডার নির্বাহী সদস্য মোহসিনা ইয়াসমিন বলেন, সিনোভ্যাক বায়োটেক (বাংলাদেশ) লিমিটেড বিডা থেকে অনুমাদন নিয়েছে। তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এই খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কাজ করছে।
একটি সূত্র জানায়, সিনোভ্যাক বায়োটেক (বাংলাদেশ) লিমিটেড ইতোমেধ্যে রাজধানীর গুলশানে প্রধান কার্যালয় নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্লাজমা সংগ্রহ সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে।
এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জনবল নিয়োগও শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার মানুষের কর্মসংসংস্থান তৈরি করবে তারা।
প্লাজমা-বেজড ওষুধ উৎপাদনের জন্য বড় আকারে একটি প্রতিষ্ঠান করার জন্য রাজধানীর কাছাকাছি কোনো একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে জায়গা বরাদ্দ নেওয়ার কাজ চলমান রয়েছে।
গত আগস্টে ওরিক্স বাংলাদেশ মানব প্লাজমা থেকে বায়োটেক পণ্য উৎপাদনের জন্য গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে দেশের প্রথম বায়োটেক শিল্প স্থাপনের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়।