পদ্মা সেতুর জন্য প্রস্তুত চীন থেকে আনা ১০০ বগি
গত ১৫ সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতু দিয়ে প্রায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ছুটেছে ট্রেন। এই প্রথম দেশে এই গতিতে ছুটল ট্রেন। এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত যাত্রী, প্রকৌশলী, চালকরা। যে কোচগুলো দিয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলল, তা আনা হয়েছে চীন থেকে। কমিশনিং করা হয়েছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায়। এখন কর্তৃপক্ষ চাইলেই এসব কোচ পদ্মা সেতু ট্রেন লাইনের উপর দিয়ে চালাতে পারবেন।
চীন থেকে আমদানি করা এমন ১০০ বগি (রেলের চাকা ও ট্রলি) ও কোচের (যাত্রী পরিহবহনকারী) বহুমুখী পরীক্ষা-নীরিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে সৈয়দপুরে। আধুনিক এসব কোচ আনা হয়েছে পদ্মা সেতুতে চলানোর জন্য।
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুতে রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প ২০১৬ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদিত হয়। প্রকল্পে খরচ ধরা হয় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুমানকৃত এ প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা দিচ্ছে। লুপ লাইনসহ মোট ২১৫.২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে।
তিন ধাপে রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে গেন্ডারিয়া-মাওয়া অংশের ৩৭ কিলোমিটার ও মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের ৪২ কিলোমিটারের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ৮৭ কিলোমিটার ভাঙ্গা-যশোর অংশের কাজ এখন পুরোদমে চলছে। সম্পূর্ণ ঢাকা-যশোর রেলওয়ে প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পের ১৭২ কিলোমিটার এ রেলপথ ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর জেলাকে সংযুক্ত করবে।
ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত এ রেললাইন সংলগ্ন ২০টি স্টেশন থাকবে। এর মধ্যে ১৪টি স্টেশন নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে এবং বিদ্যমান স্টেশনগুলোর আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্প শেষ হলে, ট্রেনগুলো ঘণ্টায় ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম হবে। আগামী ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেলপথের উদ্বোধন করবেন। এ সময় এই পথে চীন থেকে আনা আধুনিক ও নতুন কোচ এই রেলপথে চলাচল করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র ও সৈয়দপুর রেল কারখানা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা সেতু সংযোগ প্রকল্পের জন্য ৬৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার দিয়ে চীনের তৈরি মোট ১০০টি ব্রডগেজ কোচ ও বগি নিয়ে আসা হয়েছে। কোচ প্রস্তুত করেছে চীনের সিআরইসি তাংশান কোম্পানি লিমিটেড। চীন থেকে জাহাজে করে চট্টগ্রামে কোচ আসতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। প্রথমে এসব কোচ নামানো হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। সবগুলো বগিই ব্রডগেজ। কিন্তু পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে মিটারগেজ। এ কারণে মিটারগেজ লাইনে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় টঙ্গীতে নিয়ে আসা হয় বগিগুলো। এরপর সেখান থেকে ব্রডগেজ লাইনে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে সৈয়দপুর কারখানায় নেওয়া হয় বগিগুলো।
সৈয়দপুর রেল কারখানার ওয়াগন শপ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ১০০টি কোচের মধ্যে ২৫টি নন-এসি চেয়ার কোচ, ৩৫টি এসি চেয়ার কোচ, ১৫টি স্লিপার কোচ, ১৫টি ডাইনিং ও গার্ড রেক সংযুক্ত কোচ এবং ১০টি পাওয়ার কার রয়েছে। প্রতিটি কোচে আসন ১০০টি।
এসব কোচে যাত্রীর সংস্পর্শে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবে স্লাইডিং ডোর। বন্ধও হবে একই প্রক্রিয়ায়। গন্তব্যস্থল জানার জন্য মনিটর রয়েছে প্রতি কোচে। সিসি ক্যামেরা, মাইক্রোওভেন, বায়ো টয়লেটসহ প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। এসব কোচ সৈয়দপুর নিয়ে আসার পর প্রকৌশলী-টেকনিশিয়ানদের কাছে দেওয়া হয় বহুমুখী পরীক্ষা-নীরীক্ষা করার জন্য। চীন থেকে আসা পাঁচ থেকে সাতজন ও সৈয়দপুরের কারখানার প্রকৌশলী-টেকনিশিয়ানরা এসব কোচের কমিশনিং করেন। এখনো সৈয়দপুর কারখানায় চীনের ৫ জন প্রকৌশলী-টেকনিশিয়ান রয়েছেন।
কয়েক মাস ধরে কমিশনিং করার পর প্রকৌশলী-টেকনিশিয়ানরা সন্তোষ প্রকাশ করলেই সেগুলো ট্রায়াল রানের জন্য রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। এই কাজে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার দায়িত্বে ছিলেন ওয়াগন শপের ইনচার্জ সিনিয়র সাব এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. নিজামুল হক।
এই প্রকৌশলী বলেন, "চীনে যে প্রতিষ্ঠানে কোচগুলো তৈরি করা হয়েছে সেখানে ট্রায়াল রানের সুযোগ নেই। এ কারণে সৈয়দপুর কারখানা ও চীনের প্রকৌশলী-টেকনিশিয়ানদের পারস্পরিক সহযোগিতায় কোচগুলো কমিশনিং করা হয়েছে। এখানে নিয়ে এসে সাধারণত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় স্প্রিং, এয়ার ব্রেক, পানি ও বিদ্যুতের লাইন ঠিকঠাক মতো কাজ করছে কিনা। এর বাইরে ছোটখাট অনেক কাজ থাকে। সেগুলো আমরা দেখি। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো কোচ ও বগিগুলোর ক্ষেত্রে চীনের কোম্পানির ২ বছরের ওয়ারেন্টি আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো সমস্যা হলো তারা ঠিক করে দিবে এমন শর্তে বগিগুলো কেনা হয়েছে।"
কমিশনিং করে রেলওয়ের অপারেটিং অথোরিটির কাছে ৭০টি ট্রেন স্থানান্তরের কথা জানালেন সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) সাদেকুর রহমান। তিনি বলেন, "এখানে সাধারণত একটি বিষয় আমরা চেক করি তা হলো যে স্ট্যান্ডার্ডের কোচ-বগির জন্য আমরা চুক্তি করেছিলাম সেগুলো ঠিক আছে কিনা। ট্রেনলাইনে চলাচলের জন্য কোচগুলো কতোটুকু ফিট ইত্যাদি। সব পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে এই কারখানা থেকে এর মধ্যে ৭০টি কোচ বের হয়ে বিভিন্ন রূটে চলাচল করছে। বাকি যে ৩০টি কোচ কারখানায় আছে সেগুলোও ট্রেন লাইনে চলাচলের জন্য ১০০ ভাগ প্রস্তুত।"
বাংলাদেশ রেলওয়ে বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বহুমুখী দুয়ার উন্মোচিত হবে। রেললাইনের আওতায় আসবে মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল। ঢাকা-যশোর-বেনাপোল-কলকাতা পর্যন্ত এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি উপ-রুট স্থাপিত হওয়ার কথা রয়েছে। এতে জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ফ্রেইট, ব্রডগেজ কনটেইনার ট্রেন চলাচলের দ্বার খুলবে এই রুটে। একই সাথে নতুন এ লাইন স্থাপনের ফলে ১ হাজার ৬৮০টি নতুন পদের বিপরীতে কর্মসংস্থান হবে মানুষের।
পদ্মা সেতু রেললাইন আনুষ্ঠানিকভাবে অক্টোবরে উদ্বোধন করা হবে। এই লাইনে পুরোদমে ট্রেন চলাচল শুরু হবে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত। পদ্মা সেতু রেল লিঙ্কের প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, এই প্রকল্পের জন্য আনা নতুন কোচগুলো সৈয়দপুর কারখানা থেকে কমিশনিং শেষ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা পদ্মা সেতু রেললাইন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেই ট্রেন চলাচল শুরু হবে।