যেমন ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রথম নারী ব্যবস্থাপকের গল্প
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে বর্তমানে ১৬ হাজার নারী 'মিড লেভেল ম্যানেজার' হিসেবে কাজ করছেন। নারীদের এই যাত্রাটি শুরু হয়েছিল যার হাত ধরে, তিনি নাজমা চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রথম নারী কোয়ালিটি কন্ট্রোলার, ডিজাইনার ও লাইন চিফ।
বাংলাদেশের পোশাক খাত তথা ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রির পাইওনিয়ার দেশ গার্মেন্টস। ১৯৭৯ সালে দেশ গার্মেন্টস আধুনিক মেশিনে প্রশিক্ষণ নিতে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত দাইয়ু কোম্পানির পোশাক কারখানায় যেই ১৩৩ জন শ্রমিক ও মিড লেভেল ম্যানেজারকে পাঠিয়েছিল, তাদেরই একজন ছিলেন এই নাজমা চৌধুরী।
ওই সময়ে ঢাকার আর্ট কলেজ (চারুকলা ইনস্টিটিউট) থেকে সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা নাজমা চৌধুরী ৬ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরেন। অন্য আরো ১৪ নারী ছিলেন তার দলে, যাদের মধ্যে তিনি ছাড়া বাকী নারীরা ছিলেন শ্রমিক।
এই ১৩৩ জনের নেতৃত্বে শুরু হয় দেশ গার্মেন্টসের নতুন কারখানা; শুরু হয় রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা তৈরির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী বাংলাদেশ হওয়ার নতুন যাত্রা।
১৯৮০ সালের শুরুতে দেশ গার্মেন্টসের প্রথম নারী লাইন চিফ, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার এর দায়িত্বে নিযুক্ত হন নাজমা চৌধুরী।
১৯৮৪ সালে দেশ গার্মেন্টস ছাড়ার পর, তিনি ২০০৬ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে চারটি কারখানায় কাজ করেন। নিজের হাতে একে একে তৈরি করেন বিপুল সংখ্যক কোয়ালিটি কন্ট্রোলার, ডিজাইনারসহ মিড লেভেল ম্যানেজার। এছাড়াও তিনটি কারখানা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তিনি, যার মধ্যে দুটি এখনো দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে।
আজ বাংলাদেশের গর্বের এবং জৌলুশপূর্ণ পোশাক খাতের যে চিত্রটি দেখা যায়, তা ১৯৭৯ সালে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা তরুণীর সামনে কেমন ছিল? এবং সেই সময়ের সমাজের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে গিয়ে, পরিবারকে বাড়িতে রেখে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাই বা কেমন ছিল? জানতে চেয়েছিলাম নাজমা চৌধুরীর কাছে। গত দেড় দশক ধরে বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকা এবং জীবন সায়াহ্নে চলে আসা নাজমা চৌধুরী সম্প্রতি রাজধানীর লালমাটিয়ার বাসায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় জানান অনেক তথ্য।
তিনি বলেন, "১৯৭৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় বিশাল বিজ্ঞাপন দেখলাম, তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করার জন্য কিছু লোককে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য নেওয়া হবে। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে এলে তাদের চাকরি হবে।"
"ছোটবেলা থেকেই বিদেশ যাওয়ার শখ ছিল আমার। আমি আবেদন করলাম কোয়ালিটি ম্যানেজার হিসেবে। পরীক্ষায় পাশ করলাম। তখন যেসব শ্রমিককে নির্বাচন করা হয়, তাদের সবাই কমপক্ষে ম্যাট্রিক পাশ ছিল।"
তিনি বলেন, "আসলে বাংলাদেশে তখনও তৈরি পোশাক শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেনি, রপ্তানিমুখী তো নয়ই। যা ছিল, তা মূলত সেলাইয়ের দোকান। একমাত্র পুরনো ঢাকার রিয়াজ গার্মেন্টস অনানুষ্ঠানিকভাবে কিছু রপ্তানি করতো।"
তিনি আরও বলেন, দেশ গার্মেন্টস কোরিয়ার দাইয়ু-এর সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা স্থাপনের চুক্তি করে। দাইয়ু ছিল কোরিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিল্প কারখানা। তখন যেহেতু বাংলাদেশের সরাসরি বিদেশি বায়ারের কাছ থেকে অর্ডার পাওয়ার সুযোগ ছিল না, তাই চুক্তি হয়েছিল দাইয়ু অর্ডার নিয়ে দেশ গার্মেন্টসে ট্রান্সফার করবে, যার বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবে।
নাজমা জানান, তার বাবা-মা প্রশিক্ষণের জন্য কোরিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না করলেও তার চাচা তাকে যেতে দিতে চাননি। কিন্তু তিনি তাকে বোঝাতে পেরেছিলেন, এটি একটি বড় সুযোগ এবং এরজন্য কোনো টাকা খরচ করতে হবে না।
বলে রাখা ভালো, প্রশিক্ষণ শেষে দেশ গার্মেন্টসে যোগ দেওয়ার পর ১৯৮০ বা ৮১ সালের দিকে তিনি মিড লেভেল ম্যানেজার হিসেবে বেতন পেতেন ৬ হাজার টাকা, যা ওই সময়ের একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার বেতনের চেয়ে ছিল কয়েকগুণ বেশি।
তিনি বলন, "ওই সময়ে আমার ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সরকারি ডাক্তার হিসেবে মাসে পেতেন ৭০০ টাকা বেতন, আর আমি পেতাম ৬ হাজার টাকা।" একই সময়ে দেশ গার্মেন্টস নতুন শ্রমিকদের নিয়োগ দিতো কমপক্ষে ৫১০ টাকায়, যখন অন্য খাতের শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকের মজুরি ছিল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।
সেখানে ট্রেনিং কী ধরনের ছিল? নাজমা চৌধুরী জানান, মূলত বেসিক ট্রেনিং। একটি শার্ট কীভাবে তৈরি হয়। কয় ধাপে। সবগুলো ধাপ আলাদা আলাদা করে শেখানো হতো। একটি মেশিনে বসে একজন পুরো শার্ট নয়, এক একটি পার্ট তৈরি করতেন। বর্তমানে যে পদ্ধতিতে গার্মেন্টস কারখানায় কাজ হয়, ঠিক সেভাবে। অর্থাৎ চেইন প্রোডাকশন, যা বাংলাদেশে তখনও কোনো গার্মেন্টস কারখানায় ছিল না।
"৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে নিজেদের সক্ষমতা তৈরি হলে সরাসরি অর্ডার নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করি। নিজেরাই স্যাম্পল তৈরি করে বায়ারের কাছে পাঠাই। তারা অ্যাপ্রুভ করার পর সরাসরি অর্ডার আসে। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর বায়ারদের অর্ডার নিয়ে সরাসরি রপ্তানি শুরু করে দেশ গার্মেন্টস", বলেন নাজমা।
"ওই সময় বড় চ্যালেঞ্জ ছিল শ্রমিক পাওয়া। দেশ গার্মেন্টসের সাফল্যে অন্য উদ্যোক্তারাও এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন। দেশ গার্মেন্টসে কোরিয়ায় ট্রেনিং নেওয়া শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের চাহিদা বাড়তে থাকে। বেশি বেতন ও সুযোগ সুবিধায় এখানকার শ্রমিকদের ভাগিয়ে নিতে শুরু করে অন্য কারখানাগুলো", আরও যোগ করেন তিনি।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪ সালে দেশ গার্মেন্টস ছেড়ে নাজমা চৌধুরী যোগ দেন ইকবাল এন্টারপ্রাইজ নামে একটি কারখানায়। ওই কারখানায় তিনি মালিকপক্ষ হিসেবে ছিলেন। তার হাত ধরেই তৈরি হয় ইকবাল এন্টারপ্রাইজের কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্ট।
এরপর একে একে যুক্ত হন প্রয়াত ঢাকার মেয়র আনিসুল হকের মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মদী গার্মেন্টস, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ প্রতিষ্ঠিত এভিন্স গার্মেন্টস, চট্টগ্রামের ওয়েল গার্মেন্টসে।
এর বাইরেও বেশ কিছু কারখানা প্রতিষ্ঠায়, কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্ট তৈরি, এমনকি অর্ডার নোগোসিয়েশনে তিনি ভূমিকা রাখেন। তার নেগোসিয়েশন বা মধ্যস্থতায় রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের প্রথম গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়।
বর্তমানে কারখানায় ডিজাইনের সঙ্গে তখনকার অনেক পার্থক্য ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এখন তো সবই কম্পিউটারে হয়। অনেক কারখানার নিজস্ব ডিজাইন স্টুডিও রয়েছে। কিন্তু ওই সময় পেপারে ড্রয়িং করতে হতো। সহজে ওই পেপার পাওয়াও যেত না।"
দেশ গার্মেন্টসে চাকরিরত অবস্থায় ১৯৮৩ সালে বিয়ে করেন নাজমা চৌধুরী। বিয়ের পর স্বামীর অনাগ্রহে কয়েক মাসের জন্য তার কাজে ছেদ পড়লেও স্বামীকে রাজি করিয়ে আবারও কাজে যোগ দেন তিনি।
তিনি জানান, এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরেও বেশকিছু কারখানার কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্ট তৈরিতে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তবে ২০০৬ সালে সর্বশেষ ইভিন্স ছাড়ার পর আর কোনো কারখানায় কাজ করেননি তিনি। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বসবাসরত দুই সন্তানের সঙ্গেই বেশিরভাগ সময় কাটে তার। দেশে আসেন কালেভদ্রে। তার মেয়ে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আর ছেলে যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করে এখন ক্যারিয়ারেও সফল।
১২ হাজার ডলারের পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে তাদের তৈরি করা ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজ বাংলাদেশের ৩৫ বিলিয়ন ডলারের, তথা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানি শিল্প।
নাজমা চৌধুরী বলেন, "বিদেশের মাটিতে 'মেড ইন বাংলাদেশ' লেখা পোশাক দেখে কী যে ভালো লাগে.. বলে বোঝাতে পারবো না। এই কারখানা আমরাই বড় করেছি।"