পুলিশের নতুন চ্যালেঞ্জ এনক্রিপ্টেড অ্যাপভিত্তিক অপরাধ
একটি ডাকাতদল প্রায় ১০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় ডাকাতি করেছে। এ দলে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিসহ একাধিক মামলায় অভিযুক্তরাও ছিল। গ্রেপ্তার এড়াতে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করত। সবশেষ গত বছর ঢাকার দোহার, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকর প্রবাসীদের বাড়ি টার্গেট করে ডাকাতি শুরু করে।
একটি মামলা দায়েরের পর অনুসন্ধানে নামে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কিন্তু দীর্ঘ অনুসন্ধানের পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় তারা। তবে কিছুদিন আগে দলটির এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ।
সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, এই ডাকাতদলটি নিজেদের যোগাযোগের মাধ্যম পরিবর্তন করে। সরাসরি সিম ব্যবহার না করে প্রতিটি সদস্যই বিভিন্ন এনক্রিপ্টেড অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছে। ফলে এ চক্রটিকে একপর্যায়ে শনাক্ত করতে পারলেও তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে বেশ চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে একজনকে গ্রেপ্তার করে তার মুঠোফোনের হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে অন্যদেরকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়।
অপরাধীরা তাদের অপরাধের কৌশল প্রতিনিয়ত বদলায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহীনিও তাদের নিয়ন্ত্রণ কৌশলে এগিয়ে থাকে।
তবে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে গত এক দশকে সাইবার অপরাধ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। সেইসঙ্গে প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে নিজেদের আড়াল করার সুযোগও পাচ্ছে অপরাধীরা।
অপরাধীদের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা সিগন্যালের মতো এনক্রিপ্টেড অ্যাপের ব্যবহার বেড়েছে ভয়াবহভাবে। ফলে তাদের ওপর নজরদারি কিংবা নিয়ন্ত্রণে বেশ চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে পুলিশকে।
গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর চাঁদপুরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এক সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অ্যান্টি-টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। পুলিশ জানায়, অভিযুক্ত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ওই সদস্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করে উগ্রপন্থী মতবাদ প্রচার এবং অন্যদের সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতেন।
গত মাসে চট্টগ্রামের বইমেলা থেকে আরেক জঙ্গিকে আটক করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের দিন সকালে তিনি বইমেলায় হামলার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে টেলিগ্রাম গ্রুপে অন্যদের যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এছাড়া অনেকেই এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করে সাইবার অপরাধ ও অর্থপাচার করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এছাড়া সিআইডি ও ডিবি পুলিশ সম্প্রতি অনলাইন বেটিংয়ের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রায় ১০০ অনলাইন বেটিং সাইট প্রতারণা ও অর্থপাচারে জড়িয়েছে। সাইবার অপরাধীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে এবং অর্থ লেনদেনে মাস্টার এজেন্ট থেকে শুরু করে সবাই এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করেছেন। ব্ল্যাক ওয়েব বা জালিয়াতির মাধ্যমে তারা সবাই ভুয়া বা বিদেশি ফোন নম্বর নিয়ে এসব অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খোলে। ফলে এসব অ্যাপ প্ল্যাটফর্মের আড়ালে তাদের আসল পরিচয়ও গোপন থাকে।
বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. কামরুজ্জামানক টিবিএসকে বলেন, 'ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাইভেসির বিষয়টি সামনে রেখেই এভাবে তাদের ব্যবহারকারীদের সেবা দিচ্ছে। কিন্ত অপরাধীরা এর অপব্যবহার করছে।
'কোন ব্যবহারকারী আসলে অপরাধে এসব অ্যাপ ব্যবহার করছেন, সে বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানি বুঝতে পারে না। তাদের সাথে আমাদের একটা যোগাযোগ তৈরি হলে আমরা হয়তো নির্দিষ্ট করে কোনো অপরাধীর তথ্য চাইতে পারব।'
কামরুজ্জামান আরও বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের নিরাপত্তা কর্মকর্তারাই এনক্রিপ্টিং অ্যাপভিত্তিক অপরাধের মোকাবিলা করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছেন। তারা এখন বৈশ্বিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছেন বলে জানান কামরুজ্জামান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা টিবিএসকে জানিয়েছেন, এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করার জন্য জঙ্গি কার্যকলাপ, মাদক কারবার ও সাইবার অপরাধ-সংক্রান্ত কয়েক ডজন মামলা নিয়ে এখন ঝামেলায় আছেন তারা।
এছাড়া অপরাধীরা যোগাযোগের জন্য ক্রমাগত অ্যাপ বদলাচ্ছে। এটাও আরেকটি চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন অ্যাপ সাধারণত ব্যবহারকারীদের নিজেদের মধ্যে পাঠানো টেক্সট, ফাইল, ভয়েস মেসেজ বা অন্যান্য ডকুমেন্টে গুগলসহ সব ধরনের থার্ড পার্টির অ্যাকসেস আটকায়। এনক্রিপ্টেড সফটওয়্যার ডেটাকে স্ক্র্যাম্বলড টেক্সটে রূপান্তর করে, যা কেবল গোপন পাসওয়ার্ড দিয়ে ডিকোড করা যায়। এ ধরনের অ্যাপে ডেটা ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।
সারা বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত কিছু এনক্রিপ্টেড অ্যাপ হলো: হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, টেলিগ্রাম, সাইলেন্ট ফোন, সিগন্যাল, থ্রিমা।
দেরিতে হলেও বাংলাদেশ পুলিশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়েছে।
পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে সরকার। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে দেরিতে হলেও যোগাযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। এখন ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পুলিশকে প্রয়োজনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে।
কিন্ত এনক্রিপ্টেড অ্যাপগুলোর সেবাদাতাদের কাছ থেকে পুলিশ এখনও সাড়া পায়নি। ফলে এসব অ্যাপ ব্যবহার করা অপরাধীদের খুঁজে বের করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশকে।
এদিকে এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় হোয়াটসঅ্যাপের মতো মাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর জন্য নতুন একটি প্রবিধান তৈরি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। 'ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন রেগুলেশন-২০২১' শিরোনামের প্রবিধানমালার খসড়া প্রকাশ করেছে বিটিআরসি।
এতে বলা হয়েছে, ইন্টারনেটভিত্তিক এসব মাধ্যমগুলোকে বাংলাদেশে কর্মী নিয়োগ করতে হবে, সশরীর যোগাযোগের ঠিকানা থাকতে হবে, অভিযোগ নেওয়া ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। আদালত ও বিটিআরসি নির্দেশ দিলে নির্দিষ্ট কনটেন্ট ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে নিতে হবে।
এছাড়া এই প্রবিধান অনুযায়ী বিধি লঙ্ঘনকারী তথ্য মুছে ফেললেও, তদন্তের জন্য ১৮০ দিন সংরক্ষণ করতে হবে। বিধি লঙ্ঘনকারী কোনো বার্তা আদান-প্রদান করলে আদালত ও বিটিআরসির নির্দেশ সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট বার্তা প্রথম যিনি দিয়েছিলেন, তাকে শনাক্ত করে দিতে হবে।
তবে এ প্রবিধানের সমালোচনা করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তারা আশঙ্কা করছে, এই প্রবিধানের অপব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি ও জনগণের কণ্ঠরোধ করার সম্ভাবনা রয়েছে।