আমাজন প্রাইমের 'মেইড ইন হেভেন'র একটি চরিত্র তার জীবন অবলম্বনে তৈরি: ভারতীয় লেখকের অভিযোগ
সম্প্রতি আমাজন প্রাইমে মুক্তি পেয়েছে ভারতীয় ওয়েডিং প্ল্যানারদের ওপর নির্মিত একটি সিরিজ 'মেইড ইন হেভেন'। মুক্তির পরপরই এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তবে একইসঙ্গে সমালোচনারও জন্ম দিয়েছে এটি। ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের একজন লেখক ও সাংবাদিক ইয়াশিকা দত্তের দাবি, সিরিজের প্রধান একটি চরিত্র তার নিজের জীবন অবলম্বনে তৈরি, যেমনটা তিনি তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন; কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বীকারে তার নাম উল্লেখ করেননি নির্মাতারা।
৩৭ বছর বয়সী ইয়াশিকা দত্ত গত কয়েক বছর ধরে নিউইয়র্কে থাকছেন, তবে তিনি বড় হয়েছেন ভারতে একটি দলিত পরিবারে, যেখানে প্রতিনিয়ত তাদেরকে নিচু জাত বলে অবজ্ঞা করা হতো।
২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় ইয়াশিকার লেখা বই 'কামিং আউট অ্যাজ দলিত-আ মেমোয়া'। এ বইয়ে ইয়াশিকা তার ছোটবেলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, তার মা সমাজের কটূ কথা থেকে সন্তানদের বাঁচাতে তাদেরকে ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচয় দিতেন এবং সারাক্ষণ ধরা পড়ার ভয়ে তটস্থ থাকতেন তারা।
গত সপ্তাহে নিউইয়র্কে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে থাকার সময় একটা ফোন কল পান ইয়াশিকা। ভারতে থাকা বন্ধুরা তাকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কি তার বই অবলম্বনে 'মেইড ইন হেভেন' সিরিজের দলিত সম্প্রদায়ের কনের চরিত্রটি (রাধিকা আপ্তে অভিনীত) দাঁড় করাতে নির্মাতাদের অনুমতি দিয়েছেন কিনা।
সিরিজে দেখানো হয়েছে, হিন্দুদের মধ্যে নিচু জাতের একজন সাহসী নারী তার চেয়ে উঁচু জাতের একজন পুরুষকে বিয়ে করেন। ওই নারী তার জাত-পরিচয় নিয়ে মোটেও লজ্জিত নন, বরং তিনি একজন আত্মবিশ্বাসী নারী এবং তিনি নিজের সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করেন।
বন্ধুদের কথা শুনে ইয়াশিকা টিভি চালু করে সিরিজটি দেখেন এবং একজন দলিত কনেকে প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখে আবেগে উদ্বেলিত হন, যেহেতু এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। 'মেইড ইন হেভেন' সিরিজটি তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
কিন্তু পুরো সিরিজে কোথাও কৃতজ্ঞতা স্বীকারে ইয়াশিকার নাম নেওয়া হয়নি দেখে তিনি হতবাক হয়ে পড়েন; এমনকি এটি নির্মাণের আগে তার অনুমতিও নেওয়া হয়নি বলে জানান।
ইয়াশিকা দত্ত অবিবাহিত এবং ভারতে বসবাস করেন না। সেই হিসেবে সিরিজের চরিত্রটি তার মতো নয়। "কিন্তু সিরিজে ওই নারীকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন দলিত লেখক হিসেবে দেখানো হয়েছে (ইয়াশিকাও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন) যিনি জনসমক্ষে এসে কথা বলেছেন এবং বই লিখেছেন। তিনি এও বলেছেন যে তার দাদি আগে টয়লেট পরিষ্কার করতেন। আমার দাদিও এই কাজই করতেন। এটা আমারই গল্প। আমার জীবনের গল্প, আমার লেখা গল্প। অথচ কোথাও আমার নাম নেই", দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন ইয়াশিকা।
এদিকে, যেসব পাঠিক ইয়াশিকার বইটি পড়েছেন তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানতে চেয়েছেন যে সিরিজটি তার গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত কিনা। এরপরে সিরিজের পরিচালক ইনস্টাগ্রামে একজন কোলাবরেটর হিসেবে নামের তালিকায় ইয়াশিকার নাম যুক্ত করে কমেন্ট করেন এবং তাকে ধন্যবাদ জানান।
ইয়াশিকা বলেন, এতে তিনি খুশি হলেও সন্তুষ্ট নন। শুধু একটা ইনস্টাগ্রাম পোস্টই যথেষ্ট নয়। আমাজন প্রাইমের কেউই স্বীকার করেনি যে তার অনুমতি না নিয়েই 'মেইড ইন হেভেন'-এর দ্বিতীয় সিজন নির্মিত হয়েছে। কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বীকারেও তার নাম না রাখায় তিনি বেশি কষ্ট পেয়েছেন বলে জানান ইয়াশিকা।
এদিকে বৃহস্পতিবার সিরিজের পরিচালক ও প্রযোজকরা ইয়াশিকা দত্তের বই অবলম্বনে সিরিজে রাধিকা আপ্তের চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার কথা অস্বীকার করেন। তারা জানান, দলিত কনের চরিত্রটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক, এটা ইয়াশিকা দত্তের বা অন্য কারো জীবন অবলম্বনে নয়। তারা বলেন, এ বিষয়ে 'ভ্রান্ত প্রতিবেদন' ছড়িয়ে পড়ায় তারা বিরক্ত এবং 'ইয়াশিকা দত্ত ও তার লেখনীর প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে'।
আমাজন প্রাইম জানায়, সিরিজের নির্মাতারা এরই মধ্যে জবাব দিয়েছেন, তাই তারা আর কোনো মন্তব্য করবে না এ বিষয়ে।
ইয়াশিকা বলেন, "আমাদের জাতকে 'ভাঙ্গি' বলা হয়- যারা টয়লেট পরিষ্কার করে। এটা ভারতে এমনই লজ্জাজনক একটা ব্যাপার যে এই শব্দটা উচ্চারণ করাও মুশকিল। আমার গল্প সবার সামনে তুলে ধরতে আমার অনেক শ্রম দিতে হয়েছে।"
ইয়াশিকা বইয়ে তার মা শশীর কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি ভান করতেন যে তার পরিবার ব্রাহ্মণ। শশীর স্বামী ছিলেন মদ্যপ এবং তার কোনো টাকা ছিল না। কিন্তু তবুও নিজেদের ঘরবাড়ি গুছিয়ে, জন্মদিনের পার্টি ইত্যাদি আয়োজন করে নিজেদেরকে উঁচু জাত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা অব্যহত রেখেছিলেন তিনি।
ইয়াশিকা জানান, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিদারুণ সংকটে ছিলেন তারা। এক মুহূর্তের ভুল, একটা ভুল বাক্য উচ্চারণ বা ভুল অঙ্গভঙ্গিও তার আসল পরিচয় প্রকাশ করে দিতে পারতো।
"বিশ্বের লাখ লাখ লোক এই শো'টা দেখবে। এটা আমারই জীবন। এটা হবারই ছিল। দর্শকরাও দেখেছেন এবং বলেছেন। এটা শুধু আমি না। আমার বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানের কৃতজ্ঞতা স্বীকারের দাবি আমি করতেই পারি, শুধুমাত্র একটা ইন্সটাগ্রাম পোস্টের মাধ্যমে তাদের দায় শেষ হয়ে যায় না", বলেন ইয়াশিকা দত্ত।