জয়! কালো টাকার জয়!
আবারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ভাগ্যবান ব্যক্তি হিসেবে দেখা দিলেন অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকরা।
ন্যূনতম 'জরিমানা'র বিনিময়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে তাদেরকে। কিন্তু এর জন্য চড়া মূল্য চুকাতে হবে রাষ্ট্রকে।
বিশ্বজুড়ে দায়মুক্তির একটি মৌলিক ধারণা আছে। সেটি হলো, দায়মুক্তি যিনি পেতে চান তাকে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে হবে যে তিনি যে কাজটি করেছেন, সেটি অনিচ্ছাকৃত ছিল।
কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার সংসদে পাস করা অর্থবিলে কালো টাকার মালিকদের যে আইনি আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, তা দায়মুক্তির মৌলিক ধারণার পরিপন্থী।
নতুন আইনি বিধান অনুযায়ী অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকরা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর পরিশোধের মাধ্যমে বিনা প্রশ্নে টাকা সাদা করতে পারবেন। সে সময় ওই অর্থের উৎস জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা তাদের নেই।
প্রায় সর্বস্তরেই বিশ্বাস করা হয় যে সিংহভাগ অপ্রদর্শিত টাকাই এমন বেআইনি উপায়, যেমন: দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং ঘুষের মাধ্যমে উপার্জিত। এই প্রত্যেকটি কাজ ফৌজদারি অপরাধ এবং আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য। কাজেই আয়কর ট্যাক্স রিটার্নে এই টাকা অপ্রদর্শিত রাখা হয়।
তবু কালো টাকার মালিকদের একটি বিশেষ প্যাকেজ অফার করা হয়েছে, যার আওতায় মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে আগামী অর্থবছরে উৎপাদন শিল্পে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে।
শেয়ারবাজারে এ ধরনের টাকা বিনিয়োগ করলে তাদেরকে ২৫ শতাংশ নিয়মিত করের পাশাপাশি ৫ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে। একই শর্তে নগদ, ব্যাংক ডিপোজিট ও সঞ্চয়পত্র হিসেবে রাখা কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ পাবেন তারা।
লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, একজন নিয়মিত কর প্রদানকারীকেও তার আয়ের উপর ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আয়কর রিটার্নে নিয়মিত করদাতাকে তার আয়ের উৎস জানাতে হয়।
অথচ কালো টাকার মালিকরা এই আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
এই অবৈধ অর্থের মালিকরা কি দাবি করতে পারবেন যে এই অবৈধ টাকা তারা নিজেদের অনিচ্ছায়, সরল বিশ্বাসে আয় করেছেন?
কেউ যদি মনে অসদুদ্দেশ্য না রেখে কোনো অন্যায় করে ফেলেন, তাহলে তিনি আইনি সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য। এ ধরনের বিধান প্রায় অপরাধ সম্পর্কিত প্রায় প্রতিটি আইনেই আছে।
তাহলে কালো টাকার মালিকরা কেন দায়মুক্তি পাবেন? তারা আর্থিকভাবে প্রভাবশালী বলে?
টাকা সাদা করার এই সুযোগের আরও অনেক ক্ষতিকর দিক আছে।
এটি সংবিধান-প্রণীত রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির পরিপন্থী।
সংবিধানের ২০ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এমন অবস্থাসৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক-সকল প্রকার শ্র্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে৷
কালো টাকা সাদা করতে দিয়ে রাষ্ট্র একদল লোককে অনুপার্জিত আয় ভোগের সুযোগ দিয়েছে, যা সাংবিধানিক ধারার পরিপন্থী।
আর কালো টাকা সাদা করার আইনি বিধান পাস করে সংসদও সংবিধান ও রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি পরিপন্থী কাজ করেছে। এ ধারা সংবলিত অর্থবিলটি পাস করানোর জন্য যে সংসদ সদস্যরা ভোট দিয়েছেন, তাদের কেউই এই সংবিধান পরিপন্থী কাজের দায় এড়াতে পারেন না।
বিলটি পাসের সময় সংসদের সভাপতি স্পিকার বিনা প্রতিবাদে বসে ছিলেন। যদিও সংবিধানের রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষার দেওয়ার জন্য তিনি শপথ নিয়েছেন।
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, আবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব তুলেছেন যে অর্থমন্ত্রী, তিনিও মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের মতো সংবিধানের সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ করার শপথ নিয়েছিলেন।
তিনি শপথ নিয়েছিলেন, ভয় বা পক্ষপাত, আবেগ বা অসদুদ্দেশ্য থেকে মুক্ত থেকে আইন অনুসারে সব মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করবেন।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার প্রস্তাব দিয়ে সেই শপথের প্রতি কি বিশ্বস্ত থাকতে পারলেন তিনি? তিনি কি অবৈধ অর্থের মালিকদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে তাদের প্রতি পক্ষপাত করলেন না?
অবৈধ অর্থ সাদা করতে দেওয়ার যুক্তি হিসেবে বলা হলো এতে বিনিয়োগ বাড়বে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে।
কিন্তু অর্থনীতিতে কালো টাকার নেতিবাচক প্রভাব বিপুল। কালো অর্থনীতির আকার বড় হলে সমাজে আয় বৈষম্য সৃষ্টি হয়। কালো টাকার পরিমাণ দ্রুত বাড়তে থাকলে ধনীরা আরও ধনী, গরিবরা আরও গরিব হয়। আইনের শাসনের মৌলিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
তবু, যেসব আইন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ আর্থিক খাতে সুশাসনের পক্ষে কথা বলেন, তাদের সব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে বছরের পর বছর ধরে কালো টাকার মালিকদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালো টাকার উৎস বন্ধ করার জন্য আইনের প্রয়োগ নেই বলেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
অর্থমন্ত্রী খোলাখুলি ঘোষণা দিয়েছেন, যতদিন অর্থনীতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ থাকবে, ততদিন কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল থাকবে। তাই অনির্দিষ্টকাল ধরে এই খেলার ফলাফল বোধহয় কালো টাকার মালিকদের পক্ষেই যাবে।
তাই, বলাই যায়, জয় হোক কালো টাকার মালিকদের।
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা ইংরেজিতে পড়ুন: Hail dirty money holders!
- বাংলায় অনুবাদ: মারুফ হোসেন