নিজেদের দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই সাংসদদের
রাষ্ট্রের কাজ পরিচালনায় আমলাদের কারণে রাজনীতিকরা 'ম্লান' হয়ে যাচ্ছেন বলে জাতীয় সংসদের চলমান অধিবেশনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদ সদস্যরা। তাদের এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। এটা স্পষ্ট যে নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিরা দেশ শাসনে নিজেদের অবহেলিত মনে করছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই অস্বস্তিকর ঘটনাগুলোর কারণ কারণ নিহিত রয়েছে সাংসদদের নিজেদের কার্যকলাপ, কিংবা নিষ্ক্রিয়তার মধ্যেই।
সর্বত্র আমলাদের এমন উপস্থিতি তাদের প্রশাসন পরিচালনার দক্ষতা থেকে আসেনি, এসেছে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব পালনের অদক্ষতার কারণেই। সাংসদদের অদক্ষতার জন্যই আমলারা তাদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পেয়েছেন। আমলাদের বর্তমান দৌরাত্ম্যের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে আমলাতন্ত্রের অপব্যবহার।
সাংবিধানিকভাবে, মন্ত্রিসভা (সরকার) সম্মিলিতভাবে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা প্রশাসন পরিচালনায় নিয়োজিত লোকদের—তিনি মন্ত্রী বা আমলা যে-ই হন—জবাবদিহির আওতায় আনার ক্ষমতা রাখেন।
এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের জন্য রয়েছে সাংবিধানিক একটি ব্যবস্থা। আর তা হল সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থা। এসব কমিটির প্রধান থাকেন সংসদ সদস্যরাই। একজন মন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের ১০ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির সদস্য হিসেবেই থাকেন।
মন্ত্রিসভা বা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা যেকোনো বিভাগের কার্যক্রমে কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তার তদন্ত করার এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে এ কমিটি। এই ক্ষমতা সংবিধানই দিয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে, সংবিধান সংসদ সদস্যদের যে ক্ষমতা দিয়েছে, তারা কি সেই ক্ষমতা কাজে লাগান? উত্তর হচ্ছে, না।
দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কথাই বলা যাক।
২০১৯-এর গোড়ার দিকে এই কমিটি গঠনের পর থেকে, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি মাসে কমপক্ষে একটি সভা করা বাধ্যতামূলক ছিল সংসদীয় এই কমিটির। কিন্তু এ কমিটি গত আড়াই বছরে সভা করেছে মাত্র নয়টি। অথচ করার কথা ছিল অন্তত দুই ডজন সভা।
গত বছর মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই স্বাস্থ্যখাত টালমাটাল হয়ে আছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা রীতিমতো বিস্ময়কর। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অসঙ্গতির চিত্রও উঠে এসেছে।
'ওয়াচডগ' হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বলার মতো কাজ আছে খুব কমই। সুতরাং, মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না—এ কথা বলে সাংসদরা যখন ক্ষোভ উগরে দেন, তখন তা ফাঁপা বুলি বলেই মনে হয়।
আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
সরকার প্রতি বছর কোনো একটি প্রকল্পের বাড়তি খরচ জোগানোর জন্য জন্য সম্পূরক বাজেট পাস করায় সংসদে। কিন্তু এই বাজেট পাস করানোর আগে মন্ত্রণালয় বাড়তি খরচ কেন করছে এবং বরাদ্দ টাকা দিয়ে প্রকল্প কেন শেষ করতে পারছে না—এসব কারণ অনুসন্ধানের জন্য সম্পূরক বাজেটটি পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতে পাঠায় না। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালীর বিধিসমূহ পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিকে এ কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছে। যদিও এ কমিটিকে কখনও ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি। কমিটিও এখন পর্যন্ত চুপচাপ বসে রয়েছে।
অন্যান্য স্থায়ী কমিটির পারফরম্যান্সও এরকমই। ওগুলোর বেশিরভাগেরই নিয়মিত সভা হয় না, প্রশাসনিক কাজের অনিয়ম বা ব্যর্থতা তদন্ত করা তো বহু পরের কথা।
এমপিদের কমিটিগুলো যখন কার্যকর থাকে না, তখন আমলারাও জবাবদিহির আওতার বাইরে থাকেন। জবাবদিহিহীন ক্ষমতার চর্চা পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করে তোলে। এর জন্য কে দায়ী: আমলা নাকি সংসদ সদস্যরা?
সংসদ অধিবেশন চলাকালীন আলোচনায় অংশ নেওয়া বেশিরভাগ সংসদ সদস্যই গঠনমূলক কোনো পরামর্শ উপস্থাপন করেন না। ক্ষমতাসীন দলের সিংহভাগ সাংসদই বেশিরভাগ সময়ই আলোচনার সময় খরচ করেন হয় সরকারের স্তুতিতে, নইলে বিরোধী দল বা সরকারের সমালোচকদের নিন্দায়।
আইন তৈরির প্রক্রিয়ায় তারা খুব সামান্যই অবদান রাখেন। কাজেই বেশিরভাগ বিল কোনোরূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা বিতর্ক ছাড়াই পাস হয়ে যায়।
সংসদে প্রণীত আইনের পর্যালোচনা বা তাতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে সংসদ সদস্যদের। কিন্তু চার ডজন সংসদীয় কমিটির যেকোনো একটি কখনও তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
এমপিদের নিষ্ক্রিয়তা মন্ত্রিপরিষদ ও আমলাদের জন্য আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। নিজেদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই মাঠের বাইরে চলে গেছেন সংসদ সদস্যরা। সত্যি বলতে কী, আজকের এই পরিস্থিতির জন্য তারা নিজেরাই দায়ী।
সাংসদদের বর্তমান দুরবস্থার আরেকটি প্রধান কারণ তো আগেই বলা হয়েছে—রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমলাতন্ত্রের অপব্যবহার করা।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুই সাধারণ নির্বাচনে প্রশাসন যে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছিল, তা স্মর্তব্য। প্রশাসনের এই বিতর্কিত ভূমিকার সাহায্যে কেউ কেউ নির্বাচন জিতেছেন। নির্বাচনে জেতার জন্য যখন আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়, তখন আমলারা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক বিষয়গুলোতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বাড়তি শক্তি পেয়ে যান। আর তাদের সব কাজের জবাবদিহি চাওয়ার নৈতিক ক্ষমতাও রাজনীতিবিদরা হারিয়ে ফেলেন। প্রশাসনের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী করার জন্য এই সুযোগটি ব্যবহার করেছেন আমলারা।
১৯৯৬ সালে সালে তৎকালীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর প্রতি সমর্থন জানাতে আমলারা যে 'জনতার মঞ্চ' গঠন করেছিলেন, সে কথা ভুলে যাবেন না।
সুতরাং, আমলাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার আগে সংসদ সদস্যদের আত্মানুসন্ধান করা উচিত। নিজেদের কাছে তাদের প্রশ্ন রাখা উচিত: ঠিক কী কারণে সরকার এভাবে আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল?
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা ইংরেজিতে পড়ুন: MPs have none but themselves to blame
- বাংলায় অনুবাদ: মারুফ হোসেন