পরীমনি কি ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন না?
বাংলাদেশের অন্য যেকোনো নাগরিকের মতোই, চিত্রনায়িকা পরীমনিরও দোষী হিসেবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে গণ্য হওয়ার আইনগত অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার ন্যায় বিচারের অন্যতম মৌলিক নীতি হিসেবে বিবেচিত এবং সর্বজন স্বীকৃত।
চলমান পরীমনি কাহিনী অবশ্য ন্যায় বিচারের এই মৌলিক নীতির বিপরীত একটি গল্পই আমাদের বলছে।
বেশ বড়সড় একটি অভিযান চালিয়ে পরীমনিকে আটক থেকে শুরু করে, তার বাসা থেকে মাদক জব্দ এবং সেগুলো গণমাধ্যমে প্রদর্শন, তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা দায়ের এবং একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক তার চরিত্র সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য- প্রতিটি পদক্ষেপই অত্যাধিক মনে হয়েছে এবং যার ফলে ক্ষুণ্ন হয়েছে ন্যায় বিচারের রীতিনীতি।
'নির্দোষতার অনুমান' ধারণাটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর পরীমনির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণের ভার চাপিয়ে দিয়েছে। এবং পরীমনিকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, যতক্ষণ না তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের বাইরে প্রমাণিত হবে ততক্ষণ তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে না।
তবে পরীমনির কথিত অপরাধের জন্য তাকে আটককারী এবং তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের তদন্তকারী আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেই 'প্রমাণের ভার' সরিয়ে দিয়েছেন। পরীমনি দোষী কিনা তা বিচারের জন্য মামলাটি আদালতে না দিয়ে, তাকে মিডিয়া ট্রায়ালের আওতায় এনেছেন তারা।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের একাংশ এই অভিনেত্রীর চরিত্র নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন এবং গণমাধ্যমকে তার ব্যক্তিগত জীবনের বিবরণ দিয়েছেন।
গণমাধ্যমের একটি অংশও সেই বক্তব্যগুলো দিয়ে পরীমনির চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে 'রসালো' সব সংবাদ বানিয়েছে। তাকে 'খারাপ চরিত্রের' একজন নারী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য কমবেশি সবাই তাদের নৈতিকতাবোধ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
তবে, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল- এ ঘটনায় মানুষের মধ্যে এমন একটি ধারণা বিরাজ করছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মিডিয়া পুরো কাহিনীর অর্ধ-সত্য বলছে।
মানুষ মনে করছে, কাহিনীর বাকি অংশ গোপন রাখা হয়েছে সেইসব লোকদের সুরক্ষার জন্য, যারা পরীমনির কথিত অপরাধের অংশ ছিল।
মানুষের এই ধারণা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি করেছে।
এক্ষেত্রে কি সত্যিই কোন কিছু আড়াল করার প্রচেষ্টা চলছে? তারা কি সত্যিই কোন ভুল করেনি? তারা কি পরীমনি এবং বিপথে পা বাড়ানোয় সম্প্রতি যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদেরকে প্রলুব্ধ করতে নিজেদের অর্থ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি?
এই ধারণাটি পুরনো একটি নীতি বাক্যের জন্য হুমকি হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, "ন্যায়বিচার কেবল করাই উচিত নয় বরং এটি নিশ্চিত করতে দেখাও উচিত"।
পরীমনি একজন ব্যক্তি। কিন্তু যারা তার বিচারের প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছেন তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। তাদের প্রতিটি কাজ সাক্ষ্য দেয়, যে কীভাবে একটি রাষ্ট্র তার ক্ষমতা ব্যবহার করে নাগরিকদের বিরুদ্ধে; যারা সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক।
সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ যেখানে নাগরিকদের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার দেয় সেখানে নাগরিকের বিরুদ্ধে একটি মামলায় রাষ্ট্রীয় অংশীজন কর্তৃক আইনের অপব্যবহার রাষ্ট্রের ভিন্ন চরিত্রকেই তুলে ধরে।
সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে, "আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।"
দেশের অন্য সব নাগরিকের মতো পরীমনিও আইনের আশ্রয় লাভ করার অধিকার রাখেন। এবং সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনিও আইনের দ্বারা সবার মতোই বিবেচিত হবেন; যেখানে বলা হয়েছে, "সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।"
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যক্রম কি তাহলে সাংবিধানিক বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? মোটেও না। সেগুলো মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রেরও সাংঘর্ষিক। সেখানে বলা আছে, "দণ্ডযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের নিশ্চিত অধিকারসম্বলিত একটি প্রকাশ্য আদালতে আইনানুসারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ গণ্য হওয়ার অধিকার থাকবে।"
যদি জনগণ এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে একটি দেশে আইনের শাসন ভঙ্গুর এবং ধনীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে হয়, যারা অর্থ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়াকে বিকৃত করতে পারে। পরীমনি মামলাটি এমন একটি অন্যায্য পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
- লেখক: উপ নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: Doesn't Pori Moni deserve a fair trial?
- অনুবাদ: তারেক হাসান নির্ঝর