ধর্ষণের শিকার মেয়েটিই পালাতে বাধ্য হন, ধর্ষক থাকে নির্বিবাদে
আমাদের দেশে যে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হন, সেই মেয়েটির জীবন যে কতটা বিপর্যস্ত ও কষ্টকর হতে পারে, তা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। ধর্ষণের শিকার হওয়া তো অনেক বড় ঘটনা, কোনো মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হলেই এ সমাজে তার বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। যতই আমরা বলি না কেন মেয়ে তুমি ঘুরে দাঁড়াও, তোমার কোনো ভয় নেই, শক্ত হও, বিচার চাও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়েটি ও তার পরিবারকেই সমাজের কাছে হেনস্তা হতে হয় বারবার।
সমাজের মানুষের এই কটু কথার ভয়ে একজন অসহায় বাবা তাঁর মেয়েকে নিয়ে গ্রামে ফিরতে চাইছেন না। চলন্ত ট্রেনে ধর্ষণের শিকার কিশোরীকে নিয়ে গ্রামে ফিরতে তিনি ভয় পাচ্ছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, 'গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কী করবাম? মাইনষে নানা কথা কইব। এইতা (এসব) তো আমার ছেড়ি (মেয়ে) সইতে পারত না।' অথচ এই ঘটনায় ১৪ বছরের এই মেয়েটি একজন ভিকটিম। তার ওপর যৌন নিপীড়ন করেছে 'লালমনি এক্সপ্রেস' ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট আক্কাস গাজী। গাজীর কী শাস্তি হবে, কবে তার বিরুদ্ধে আনা তদন্ত শেষ হবে, আদৌ কোনো শাস্তি হবে কি না, তার পরিবার বিষয়টিকে কীভাবে দেখবে, এটা আমাদের সমাজে পরের ভাবনা। আমরা ধরেই নিই অপরাধ নারীর। দেশে ও সমাজে ধর্ষণের শিকার নারী ও মেয়ে যতটা ঘৃণিত ও অবহেলিত হন, ধর্ষণ যে করে সে ততটা নয়। বরং ফাঁক গলে বেরিয়ে আসার অনেক নজির আছে।
এরকমই এক পরিস্থিতিতে বাস করে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ধর্ষণের শিকার আরেক নারী ও তাঁর বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের। ২০২২ সালে রাতে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল পরিবহনের চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। চলন্ত বাসে ডাকাতির সময় একমাত্র প্রতিবাদ করা ব্যক্তি ছিলেন ওই নারী। তিনি পোশাক কারখানায় কাজের খোঁজে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলেন। ওই নারী ডাকাতদলের দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। দেড় বছর আগের সেই ঘটনায় হওয়া মামলা এখনো সাক্ষ্য পর্যায়ে। এরমধ্যে সমাজের কটু কথা তাকে ও বাবা-মাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এদের কারণেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসে তিনি কাজ খুঁজছেন। "গ্রামের লোকজন ওই ঘটনার জন্য আমাকেই দায়ী করেন। বলেন, তোর মেয়ে 'জরিমানা' (ধর্ষণের দুর্ভোগ) নিয়া ফিরছে। আমাকেও কথা শোনায়। যতই বলি, আমার কী দোষ? ওটা তো একটা দুর্ঘটনা। ওটায় কি আমার কোনো হাত আছে? কিন্তু কে শোনে কার কথা! ওদের কথা ওরা বলতেই থাকে।" ওই নারীর ভাষায়, তাঁর 'কপালটাই পোড়া'। ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বাবাও যেমনটা বলেছেন, "সবডাই আমরার মতো গরিবের দুর্ভাগ্য।"
সত্যিই তাই, বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার নারী বা মেয়েকেই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। গ্রাম্য সালিশে মেয়েদেরই বিচার করা হয়। একঘরে করা হয় তাদেরই পরিবারকে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ ও ২০২২ সালে মামলার ৫২ শতাংশ ছিল ধর্ষণের, আগের চার বছরে এ হার ৪৮ শতাংশের নিচে ছিল। প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে ধর্ষণের 'বিচার' হচ্ছে সালিশে। সাজা হচ্ছে জরিমানা, চড়-থাপ্পড়। এরকম কয়েকটি ঘটনার কথা সংবাদে তুলে ধরা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে শিশু ধর্ষণ, কিশোরী ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ।
ধর্ষণের শিকার পরিবার বিচারের আশায় সপ্তাহ দুয়েক এর-ওর কাছে ধরনা দেয়। থানায় গিয়ে মামলা করেয়। কিন্তু ধীরগতির কারণে মামলা এগোয় না, বাদী আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, সাক্ষী হারিয়ে যায়, আলামত নষ্ট হয়ে যায়, অপরাধীরা জামিন পায় এবং ভয় দেখাতে শুরু করে মামলা তুলে নেয়ার জন্য। আমাদের দেশে সামাজিক অবস্থায় একজন ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবার খুব ট্যাবুর মধ্যে থাকেন ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনার পর। তারা ভাবতে বাধ্য হন মামলা করবেন কি না, সবার সামনে যাবেন কি না, বিচারের মুখোমুখি হবেন কি না, মামলার ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন কি না, আসামিপক্ষ শক্তিশালী কি না ইত্যাদি। এইসব ভাবনা-চিন্তাতেই পার হয়ে যায় বেশ কিছুদিন। এটাই আমাদের কঠিন বাস্তবতা। যে নারী-কিশোরী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হন, প্রথমেই তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে ট্রমায় চলে যান। ধর্ষণের পর বেশিরভাগ ভিকটিমের পরিবার এবং তার আত্মীয়স্বজন ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়।
ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা খুব সহজে সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হয়। সামান্য টাকা হাতে তুলে দেওয়া হয় ভিকটিমের পরিবারের হাতে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণের অভিযোগে সালিশে মীমাংসা করার ঘটনা ঘটছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আইন ও বিচারবহির্ভূত সালিশে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩টি সালিশ হয়েছে ধর্ষণের ঘটনায়।
সালিশের ঘটনা আমাদের সমাজে, বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে খুব প্রচলিত ও সহজ পদ্ধতি। যদিও যে-কেউ, যখন-তখন সালিশ করতে পারেন না। ধর্ষণের ঘটনার তো সালিশ হয়ই না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে মুফতি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান মুফতির বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, মুফতি নন, এমন কেউ কোনো সালিশে ফতোয়া দিতে পারবেন না। আর ফতোয়া নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ফতোয়ার মাধ্যমে দোররা মারা, বেত্রাঘাত ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। শাস্তির বিষয় এলে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। ধর্ষণ, হত্যার মতো ঘটনায় প্রচলিত আইনে বিচার হতে হবে। যেখানে-সেখানে গ্রাম্য সালিশ ডেকে ফতোয়া দেওয়া রুখতে গণমাধ্যমের বেশি করে প্রচার চালানো উচিত।
ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে উচ্চ আদালত রায় দেন। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে ২০১৫ সালে বিচারবহির্ভূত ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা বহাল রেখে বলা হয়, ধর্মীয় আইনবিশেষজ্ঞ বা ফিকাহশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি শুধু ফতোয়া দিতে পারবেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ধর্ষণ হচ্ছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। এটা এতটাই গুরুতর অপরাধ যে রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করতে পারে এবং শাস্তি হতে হবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। এ ধরনের অপরাধ মীমাংসা করা বা শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার সালিসকারীদের নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সালিশে ধর্ষণের বিচারের রায় নারীর বিপক্ষে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শারমিন আক্তার অন্য এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, বাংলাদেশের আইনে কিছু অপরাধ আছে যেগুলোর কোন আপস-মীমাংসার সুযোগ নেই। ধর্ষণের ঘটনা তেমনি একটা, যেখানে কোনো আপসের সুযোগ নেই। যেখানে বাংলাদেশের আইনে বলা হয়েছে ধর্ষণ বা ধর্ষণের পরে হত্যার ঘটনায় কোনো আপস-মীমাংসার প্রশ্নই আসে না।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু সালিশে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নামমাত্র সাজা দেওয়া হচ্ছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জরিমানা করা, চড়-থাপ্পড় দেওয়া কিংবা জুতাপেটা করা হচ্ছে। সালিশকারীরা এর জন্য 'কমিশন' বা আর্থিক সুবিধা নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। খুব সামান্য কারণেও ঢোল পিটিয়ে দুটি মেয়েকে ঢোল পিটিয়ে সমাজচ্যুত করার মতনও বিধান দেয়া হয়েছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে। সালিশের পর গৃহবধূর চারিত্রিক অপবাদ দেয়ায় আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
২০২১-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৫ বছরে আদালতে ধর্ষণ মামলা ৩০ হাজার ২৭২টি। কিন্তু কতজন অপরাধী ধর্ষণের দায়ে শাস্তি পেয়েছে? কতজনের বিরুদ্ধে সাক্ষী পাওয়া গেছে? কতজন প্রমাণের অভাবে বের হয়ে এসেছে? পরিবারগুলো কেন সালিশের দ্বারস্থ হয়, এ প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, ঘটনা ঘটার পর আইন সম্পর্কে সচেতনতা না থাকা এবং মেয়ের 'সম্ভ্রমহানির' ভয়ে অনেক পরিবার বুঝে উঠতে পারে না ধর্ষণ-পরবর্তী কী পদক্ষেপ নেবে তারা। তাদের এ সময়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে গ্রামের মাতবর শ্রেণি ও স্বার্থান্বেষী মহল বোঝাতে থাকে, আইনের দ্বারস্থ হলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। তারা সালিশ করে একটা বিচার পাইয়ে দেবে। বিচার করিয়ে দেওয়ার নামে সালিশকারীরা দুই পক্ষ থেকে কমিশনও নেন। মূলত বিচার চাওয়ার জন্য সহজে আইনের কাছে পৌঁছাতে না পারা ও দীর্ঘসূত্রতায় বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কারণেও আদালতের পরিবর্তে সালিশের দ্বারস্থ হন অনেকে।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দেয়া। ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে কতটা নৈতিক বা কীভাবে এই বিয়েটা হওয়া সম্ভব? যে নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে, সে কীভাবে তারই ধর্ষণকারীর গলায় মালা পরিয়ে তার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে? ২০২২ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার এক নারীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে হয়েছে ধর্ষকের। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে এই বিয়ে হয়েছে। মামলা চলা অবস্থায় ভিকটিম সেন্টারে ছেলে সন্তানের জন্ম দেন বাদী। ছেলের বয়স যখন দুই বছর, তখন আদালতের অনুমতি নিয়ে ধর্ষক ভিকটিমকে বিয়ে করে এবং জামিনে বের হয়ে আসে। অবশ্য আদালত রায়ে তার পর্যবেক্ষণে বলেন, "এই মামলাটাকে খারিজ করা হচ্ছে না। মামলাটা আমার কাছেই থাকবে। আমি দীর্ঘ একটা সময় নিয়ে মামলাটাকে পর্যবেক্ষণে রাখব—আসলেই ভিকটিম সুখে আছে কি না, আসামি তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে কি না, তাকে সুখে রাখছে কি না,' এসব দেখবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শারমিন আক্তার ধর্ষকের সাথে ভিকটিমের বিয়ে প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিয়েটাকে "জামিনের একটা গ্রাউন্ড" হিসেবে ব্যবহার করে অপরাধীরা। বিচারকরা যখন দেখেন যে বিয়ে হয়ে গেছে, কাজেই জামিন দিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু পরে এই মামলাগুলো আর এগিয়ে যায় না। কারণ ওই আসামির প্রতি মামলা চালানোর ইচ্ছাটা বাদীর আর থাকে না। কিন্তু মামলা চালু থাকে। তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে সমাজে একটা ভুল বার্তা যায়। কারণ যারা ধর্ষক, তারা মনে করে আমি ধর্ষণ করলাম এবং যাকে ধর্ষণ করলাম, তাকে বিয়ে করার মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে গেলাম। সেক্ষেত্রে ধর্ষণের জন্য যে বিচার। সেটা আর পেতে হয় না। অর্থাৎ ফলোআপ থাকে না। এমনও দেখা গেছে বিয়ে করার পর ধর্ষকের জামিন হয়ে গেলে, সে মেয়েটিকে তালাক দিয়ে দেয়। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, নির্যাতিত নারীকেই ভোগ করার কী চমৎকার একটা ব্যবস্থা করে দেয় সমাজ।
এদিকে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবার হয়তো ভাবে বিয়ের মাধ্যমে মেয়েটির একটি হিল্লে হলো বা সমাজে মুখ দেখানোর একটা ব্যবস্থা হলো। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে নিয়ে তার পরিবার কোথায় যাবেন, কে বিয়ে করবে তাকে? হয়তো ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবারকে পালিয়ে বেড়াতে হবে। তাই ধর্ষকের সাথে বিয়ে নামক সমাধানের মাধ্যমে ভয়ংকর একজন দানবের সাথে মেয়েটিকে সহবাস ও বসবাস করতে বাধ্য করা হয়।
- শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক