সেনাবাহিনীতে ভর্তি এড়াতে গা ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছেন ইউক্রেনীয় পুরুষেরা
সেরি আর তানিয়ার বিয়েতে খুব বেশি মানুষ আসেনি। আকাশে মেঘ কালো করে আছে, কিন্তু নিচে বিয়ের মঞ্চের ফাঁকা আসনগুলো যেন আরও বেশি অন্ধকারে ঢেকে আছে। প্রায় অর্ধেকের বেশি নিমন্ত্রিত অতিথি বিয়েতে উপস্থিত হননি। খবর বিবিসি'র।
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে নতুন সৈন্য সমাবেশ করতে নির্দিষ্ট বয়সের বেসামরিক নাগরিকদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে হচ্ছে। তানিয়ার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের অনেকে কনস্ক্রিপশন স্কোয়াডের হাতে না পড়তে বিয়েতে আসা এড়িয়ে গেছেন।
ইউক্রেন সশস্ত্রবাহিনীর কনস্ক্রিপশন স্কোয়াডটি (কনস্ক্রিপশন — বাধ্যতামূলকভাবে সেনাদলে নিযুক্ত করা) এখন রাস্তা, রেস্তোরাঁ, রেল স্টেশনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধ করার উপযুক্ত বয়সের কাউকে চোখে পড়লেই তাদেরকে পাকড়াও করার অভিযোগ রয়েছে এটির বিরুদ্ধে।
দুই বছরের বেশি সময় চলা যুদ্ধে ইউক্রেনের অনেক সৈন্য নিহত, আহত আর শ্রান্ত। এ অবস্থায় নতুন করে সেনা সমাবেশের উদ্দেশ্যে নতুন আইন করেছে কিয়েভ।
মে মাসে চালু করা ওই আইন অনুযায়ী ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সি প্রতিটি ইউক্রেনীয়কে তাদের বিস্তারিত তথ্য একটি ইলেকট্রনিক ডেটাবেজে প্রবেশ করাতে হচ্ছে, যাতে তাদেরকে যখন-তখন ডাকতে পারে সেনাবাহিনী। যারা ডেটাবেজে তথ্য দেননি, তাদরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে কনস্ক্রিপশন অফিসারেরা।
এর ফলে ইউক্রেনে আরও বেশি পুরুষ আত্মগোপনে চলে যাচ্ছেন।
তানিয়ার বাবা আভদিভকার যুদ্ধে নিহত হন। ২৪ বছর বয়সি এ তরুণী এখন আতঙ্কে আছেন, তার সদ্যবিবাহিত স্বামীকেও জোর করে যুদ্ধে পাঠানো হয় কি না। 'আমার পরিবারে এটা দুবার হোক, তা আমি চাই না,' বলেন তিনি।
দুবছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধে ইউক্রেন। দেশটির বেশিরভাগ মানুষের পরিচিত কেউ না কেউ যদি যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
তানিয়া-সেরি'র দেড় দশকের বন্ধু মাকসিমের প্রায় এক ডজন বন্ধু বা পরিচিতজন যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। ফোনে তিনি বলেন, 'ইউক্রেনে ১০ লাখের বেশি পুলিশ সদস্য রয়েছে, ওরা যখন যুদ্ধ করছে না, তখন আমি কেন যুদ্ধ করব?'
কনস্ক্রিপশন স্কোয়াড ইতোমধ্যে দেশটিতে, বিশেষ করে ওডেসায় কুখ্যাতি অর্জন করেছে। মানুষজনকে বাস থেকে নামিয়ে, ট্রেন স্টেশন থেকে ধরে নিয়ে সোজা এনলিস্টমেন্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দিচ্ছে এটি।
যারা কনস্ক্রিপশন এড়িয়ে চলছেন, তারা এখন আর গণপরিবহন ব্যবহার করতে পারেন না। রেস্তোরাঁতেও নির্ভার হয়ে বসার সুযোগ নেই, সুপারমার্কেটে যাওয়াটাও ঝুঁকিপূর্ণ। সপ্তাহান্তে পার্কে গিয়ে ফুটবল খেলাটাও এখন তাদের কাছে অতীত স্মৃতি।
'মনে হচ্ছে কারাগারে আছি,' মাকসিম বলেন।
আনাতোলি আর তার জুনিয়র, পেটা শরীরের ওলেকসি দুজনেই কনস্ক্রিপশন অফিসার। এক মঙ্গলবার সকালে ওডেসা স্টেশনে নেমে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ইলেকট্রনিক ডেটাবেজে নাম না লেখানো কাউকে পেলেন না তারা।
শেষতক আনাতোলি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, মানুষজন গা ঢাকা দিয়ে আছে। 'কেউ দেখলে পালিয়ে যায়। এটা প্রায়ই হয়। অনেকে রূঢ় প্রতিক্রিয়া দেখায়। ব্যবহারে বংশের পরিচয়,' বলেন এ কর্মকর্তা।
এনলিস্টমেন্ট সেন্টারের দরজার গায়ে লেখা, যারা স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে এসেছেন, তাদেরকে লাইনে দাঁড়াতে হবে না। তবে কক্ষের ভেতর কেবল একজন লোক বসে আছেন।
তিনি কি স্বেচ্ছায় এসেছেন কি না জানতে চাইলে উত্তর দেন, তিনি 'ছিনতাইয়ের শিকার' — সকালে তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
'অফিসারগুলো আমার চারপাশ ঘিরে ধরেছিল যাতে আমি পালাতে না পারি,' বলেন তিনি।
কনস্ক্রিপশনের কারণে ইউক্রেনীয় সমাজে এখন বিভক্তিও তৈরি হচ্ছে। যারা যুদ্ধ করছেন বনাম যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের মধ্যকার বিভাজনের পাশাপাশি যেসব নারীর সঙ্গী যুদ্ধে গেছেন বনাম যারা নিজেদের সঙ্গীদের লুকিয়ে রেখেছেন, তাদের মধ্যেও বিভক্তি তৈরি হয়েছে।
সেনা সমাবেশের কথা এখন ইউক্রেনীয়দের যেকোনো আড্ডাতে চলে আসে। কখনো কখনো তা থেকে সূচনা হয় উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের। গত মাসে জনৈক এনলিস্টমেন্ট অফিসারের বাড়ির বাগানে কেউ একজন বিস্ফোরক ছুড়ে মেরেছিল।
যারা বাধ্যতামূলকভাবে সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দিতে চাচ্ছেন না, তারা এক ধরনের অবিশ্বাসের মধ্যে রয়েছেন। দেশ ছাড়তে সহায়তা করতে ঘুষ নেওয়ার সময় অতীতে অনেক সেনা কর্মকর্তা ধরা পড়েছেন, তাই অফিসারদের এসব মানুষ বিশ্বাস করতে পারছেন না। অনেকে মনে করেন, তাদেরকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই রণাঙ্গনে পাঠানো হবে। অনেকের আশঙ্কা, যুদ্ধক্ষেত্রে তাদেরকে স্রেফ মৃত সৈন্যদের স্থানপূরণের জন্য নেওয়া হবে।
কিয়েভের বাইরে একটা জঙ্গলে বাধ্যতামূলকভাবে ভর্তি করানো সৈন্যদের প্রশিক্ষণ চলছে। তাদের অধিনায়ক হেনাদি সিনতসভ কয়েকজন সৈন্যের পরিখা খনন তদারকি করছেন।
'কাজটাকে মামুলি মনে হতে পারে, কিন্তু এটা আর্টিলারি গোলা ছুড়তে পারার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এ গর্তগুলো ওদের জান বাঁচাতে পারে,' বলেন তিনি।
সামরিক ইউনিটে পাঠানোর আগে প্রতিটি সেনাকে ৩৪ দিনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এর দেখাশোনা করেন সিনতসভ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এ মানুষদের সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হবে না, তাদেরকে আরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
সিনতসভের দলের সৈন্যদের বয়স ৪০ থেকে ৫০-এর কোঠায়। একজন শূকর পালক, অন্যজন ওয়্যারহাউজ ম্যানেজার, আরেকজন বিল্ডার। সবাই স্বীকার করলেন, যুদ্ধে যাওয়ার তাদের কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু সারাজীবন তারা লুকিয়েও কাটাতে চান না।
নতুন নিযুক্ত সেনাদের মনোবলের প্রচণ্ড অভাব। সিনতসভের মতে, রণাঙ্গন থেকে অনেক দূরে শহরের আরামে বাস করতে করতে এ মানুষগুলো এখন আর যুদ্ধের হুমকি নিয়ে বিশেষ ভয় পাচ্ছেন না। তার আশঙ্কা, কনস্ক্রিপশন এড়ানো বন্ধ করে মানুষকে স্বেচ্ছায় অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার জন্য আরেকটি রুশ অভিযানের দরকার হতে পারে।
'তখন আবার দেখা যাবে মানুষ বন্দুক খুঁজে বেড়াচ্ছে, এনলিস্টমেন্ট সেন্টারে লাইন ধরছে,' বলেন তিনি।