কমেডিয়ান থেকে যুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট: কেমন কাটছে জেলেনস্কির দিনরাত
মেজাজি, অধৈর্য, ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না — ইউক্রেনের যুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দিন বর্তমানে এভাবেই কাটছে। বয়স এখন ৪৬-এর কোঠায়। ২০১৯ সালে প্রথম ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন; স্বপ্ন ছিল স্বদেশকে রূপান্তরিত করবেন আধুনিক গণতন্ত্রের একটি দেশে।
কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়ার হামলা তার স্বপ্ন, উদ্দেশ্যকে ছারখার করে দিলো। তারপর থেকে তার দিন কেমন কাটছে? যুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দৈনন্দিন জীবন কীভাবে পার করছেন এক সময়ের কমেডিয়ান পেশায় থাকা এ ব্যক্তি? বিস্তারিত জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছিলেন, তখন রাজনীতিতে অতটা পাকা ছিলেন না জেলেনস্কি। কিন্তু এ দুবছরে তিনি পরিণত হয়েছেন একজন পোড়-খাওয়া মানুষে, সামলাচ্ছেন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতি — এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গেও নিয়মিত দরকষাকষি করছেন ভলোদিমির জেলেনস্কি।
রয়টার্স-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি অবশ্য তাকে নিয়ে করা প্রশ্নগুলো বেশিরভাগ সময়ই এড়িয়ে গিয়েছেন। তার বদলে ইউক্রেনের যুদ্ধকালীন কিছু মিত্রকে নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। তার মৌলিক বার্তাটি এখনো অটুট রয়েছে: সাহায্যের জন্য পশ্চিমাবিশ্বের আরও বেশি [কাজ] করতে হবে।
জেলেনস্কির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন, এমন আটজন সাবেক ও বর্তমান ইউক্রেনীয় ও বিদেশি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। এছাড়া প্রেসিডেন্টের অতীত জীবনের কিছু বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীও জানিয়েছেন তাকে নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতার কথা।
তাদের চোখে জেলেনস্কি এখন অতীতের সেই তরুণ জেলেনস্কি নেই। তিনি এখন আরও কঠিনচিত্ত, আরও বেশি দৃঢ়সংকল্প। জেলেনস্কি এখন আগের মতো ভুলের জন্য সহজে ক্ষমা করে দেন না। আর দিন-রাত চাপের মুখে থেকে তিনি আগের চেয়ে বেশি প্যারানয়ায় ভুগছেন।
জেলেনস্কির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভের ভাষায়: 'এটা একটা নির্ঘুম রেজিম।' তিনি জানান, জেলেনস্কি এখন আর স্থির থাকতে পারেন না, তাকে প্রায়ই ইউক্রেনের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়াতে হয়। এজন্য ছোট একটা ব্যাকপ্যাকেরও ব্যবস্থা করে ফেলেছেন তিনি। সে ব্যাগে থাকে একজোড়া পোশাক আর টুথব্রাশ। কারণ প্রেসিডেন্ট নিজেও জানেন না, আজকের রাতটা তাকে কোথায় কাটাতে হতে পারে।
'এ হচ্ছে প্রেসিডেন্টের আটপৌরে জীবন এখন — নির্ঘুম রাতজুড়ে তিনি পরামর্শাসভা করে কাটান। দিন নেই রাত নেই, পার্লামেন্ট, সিনেটে কথা বলতে হয়। সপ্তাহের সাতদিন ২৪ ঘণ্টাই তিনি চাপ নিয়ে থাকেন,' বলেন রেজনিকভ।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে কাজ করা একজন কর্মকর্তা জানান, জেলেনস্কির যদি মনে হয় কোনো কর্মকর্তা বা উপদেষ্টা পুরোপুরি প্রস্তুত নন অথবা তারা কোনো বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধে রয়েছেন, তাহলে তিনি তাদেরকে সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশও দেন।
তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের অবশ্য একটি বিষয়ে সবার একই সুর: তারা জেলেনস্কির মানসিক সহ্যক্ষমতা দেখে অভিভূত। রেজনিকভের ভাষায়, 'জেলেনস্কির স্মৃতিশক্তি তার একটা বড় শক্তি। তিনি মাথায় বিপুল পরিমাণ তথ্য ধারণ করতে পারনে। খুব দ্রুতই তিনি কোনো কিছুর বিস্তারিত ও সূক্ষ্ম উভয় দিকই ধরতে পারেন।'
জেলেনস্কির সঙ্গে একসময়ে আলোচনায় বসেছিলেন এমন একজন জ্যেষ্ঠ ইউরোপীয় কর্মকর্তা জানান, রাশিয়ানরা তাকে গুপ্তহত্যা করবে এবং ইউক্রেনীয় নেতৃত্বকে অস্থিতিশীল করে তুলবে, এমন সন্দেহে জেলেনস্কির 'প্যারানয়া' ক্রমশ বাড়ছে।
১৯৯০-এর দশকে মধ্য ইউক্রেনের ক্রিভি রি নামক একটি শহরে বেড়ে ওঠেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। সেখানেই তিনি ভারতাল ৯৫ নামক একটি কমেডি দল গড়ে তোলেন। এ দলের একজন লেখক আর্তেম গ্যাগারিন খুবই আশ্চর্য হয়েছিলেন যখন তিনি জানলেন, তার বস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে লড়বেন।
'তিনি ছিলেন ইউক্রেনের সবচেয়ে সেরা কমিকদের একজন। আদতে এ লাইনে তিনিই সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন। তার কেন প্রেসিডেন্ট হতে হবে,' বলেন গ্যাগারিন।
পাঁচ বছর পর এখন আর্তেম গ্যাগারিন কৃতজ্ঞবোধ করেন, তার সহকর্মী জেলেনস্কি সেদিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বলে। জেলেনস্কি এখন সহজাত নেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। 'নাহলে আমরা এখন কই যে থাকতাম,' বলেন গ্যাগারিন।
তবে স্বদেশে জেলেনস্কিকে এখন সবাই একই চোখে দেখেন না। ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের শিকার হওয়ার পরপর জনসাধারণের মধ্যে তার পক্ষে ৯০ শতাংশ ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও, দীর্ঘদিনের যুদ্ধের ক্লান্তি, বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে নিয়োগের সরকারি সিদ্ধান্ত, জাঁদরেল জেনারেলদের বরখাস্ত করা এবং যুদ্ধক্ষেত্রের করুণ পরিস্থিতি জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে তার 'পাবলিক অ্যাপ্রুভাল' হার ৬০ শতাংশের আশপাশে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সামরিক কৌশল, শাসনব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে জেলেনস্কির প্রধান রাজনৈতিক বিরোধীদের কিছু বলার বিশেষ সুযোগ নেই বর্তমান ইউক্রেনে। প্রেসিডেন্ট ও তার দলের হাতে এত বেশি ক্ষমতা থাকা নিয়ে খুশি নন অনেক সাধারণ ইউক্রেনীয়ও।
হাউজ ফরেইন অ্যাফেয়ার্স কমিটি রিপাবলিকান চেয়ার ও মার্কিন প্রতিনিধি মাইকেল ম্যাককল ইউক্রেন ও ওয়াশিংটনে জেলেনস্কির সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি রয়টার্সকে বলেন, ভলোদিমির জেলেনস্কি তার শুরুর অবস্থান থেকে এখন একজন উৎসাহব্যঞ্জক যুদ্ধকালীন নেতা হিসেবে ক্রমশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
আর এ পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল যখন কিয়েভের দিকে রাশিয়ান বাহিনী এগিয়ে আসার সময় পশ্চিমাদের সাহায্য নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলেন তিনি, বলেন ম্যাককল।
'জেলেনস্কি সবসময় সিরিয়াস এবং তিনি সবসময় কাজের কথা বলেন,' জানান এ মার্কিন কর্মকর্তা।
তবে ম্যাককল বা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো সমর্থক থাকা সত্ত্বেও গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনীয়দের দুঃখ নিয়ে বিশ্বের মনোযোগ ধরে রাখতে হিমশিম খেয়েছেন ভলোদিমির জেলেনস্কি।
ইউক্রেনের এ নেতা পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো নিয়ে মারাত্মক নাখোশও এখন। কিন্তু এর ফলে তিনি যেন তার অতি-প্রয়োজনীয় পশ্চিমা মিত্রদের দূরে সরিয়ে না দেন, সে নিয়েও অনেকে তাকে পরামর্শ দিয়েছেন।
ব্যতিক্রম এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের নেতা হিসেবে তিনি কেমন নৈপুণ্য প্রদর্শন করছেন, এমন প্রশ্নের জবাব অবশ্য জেলেনস্কি দেননি।
কিয়েভে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আমি নিজের কাজের মূল্যায়ন করতে পারব না, সেটাকে [মূল্যায়ন] খুব নৈতিক বলে আমি মনে করি না।'
'আমি গর্বিত আমি ইউক্রেন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট — এ পাঁচ বছর নিয়ে আমার মনোভাব এটাই,' নিজের ক্ষমতার পাঁচ বছর পূর্ণ করা প্রসঙ্গে বলেন তিনি।