৭৫ হার্ড: জনপ্রিয় টিকটক ফিটনেস চ্যালেঞ্জ কি আসলেই কাজে লাগে?
আপনার নতুন বছরের রেজোলিউশনের তালিকায় '৭৫ দিনের ওয়ার্কআউট' নাও থাকতে পারে। তবে এই বছর সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিষয়টি বেশ ভাইরাল হয়েছে। অনেক মানুষই এটি অনুসরণ করে নিজেদের জীবনে আসা পরিবর্তনের কথা টিকটকে শেয়ার করছেন।
প্রথমত এতে কিছু মৌলিক নিয়ম রয়েছে: একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েট মেনে চলতে হবে, এতে কোনো চিট মিল বা অ্যালকোহল থাকবে না। তারপর ৭৫ দিন প্রতিদিন আপনাকে ৪৫ মিনিট করে দুইবার শরীরচর্চা করতে হবে। এর মধ্যে একবার অন্তত বাড়ির বাইরে গিয়ে শরীরচর্চা করতে হবে।
এছাড়াও, দিনে তিন লিটারের বেশি পানি পান করতে হবে এবং একটি নন-ফিকশন বইয়ের ১০ পৃষ্ঠা পড়তে হবে।
এগুলো শুনে বেশ সহজ মনে হচ্ছে, তাই না? তবে কেউ যদি এই চ্যালেঞ্জ নিতে চান, তাহলে আগে বিষয়টি ভালোভাবে ভাবনাচিন্তা করে নিন।
কারণ এই চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করেছেন এমন দুজন মানুষ আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তারা এই চ্যালেঞ্জকে বেশ কঠিন বলেই জানিয়েছেন। এছাড়া, বিশেষজ্ঞরাও সতর্ক করে বলেছেন, এর চেয়ে আরও অনেক সহজে ও স্বচ্ছন্দেও ওজন কমানো সম্ভব।
'আমার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ'
গত বছরের মার্চ মাসে ৭৫ হার্ড সম্পন্ন করেছিলেন ২৯ বছর বয়সী দেবাংশু গনপুত। সেসময় তিনি একটি বড় কর্পোরেশনের ডিজিটাল পরামর্শদাতা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'এটা অবশ্যই কঠিন ছিল। এছাড়াও আমি সেসময় এডিনবরা শহরে থাকতাম। শহরটিতে সেসময় অন্ধকার, বৃষ্টি ও ঠান্ডা ছিল। আর শর্ত হিসেবে আমাকে একবার বাড়ির বাইরে শরীরচর্চা করতেই হতো।'
দেবাংশু জানান, ৭৫ হার্ড চ্যালেঞ্জের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিকগুলোর মধ্যে একটি ছিল পরিবারের মানুষদের দেখতে যাওয়ার সময় তার ডায়েটের ব্যাপারে স্থির থাকার জন্য 'বাউন্ডারি নির্ধারণ' করা।
তিনি বলেন, 'প্রতিদিন দুবার ব্যায়াম করা এবং ডায়েটের ব্যাপারে কঠোর থাকা আমার জন্য খুব অস্বস্তিকর ছিল। এটি আমার জন্য নতুন একটি চ্যালেঞ্জ ছিল, কারণ আমি আগে কখনো এমন কিছু করিনি।'
কিন্তু চ্যালেঞ্জ শেষ করার পর তিনি এখন নিজের ওপর এর স্থায়ী প্রভাবগুলো লক্ষ্য করছেন।
তিনি বলেন, 'আমি এখন অনেক বেশি নিয়মিত ব্যায়াম করি, আমার বই পড়ার অভ্যাস এবং খাবারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক পুরোপুরি বদলে গেছে।'
৭৫ হার্ড যদিও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি ভাইরাল ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে, তবে আসলে ২০১৯ সালে লেখক ও পডকাস্টার অ্যান্ডি ফ্রিসেলা এটি উদ্ভব করেছিলেন।
তিনি তার পডকাস্টে বলেছিলেন, তিনি 'মানসিক দৃঢ়তা কীভাবে আয়ত্ত করবেন তা নির্ধারণ করতে ২০ বছর ব্যয় করেছেন' এবং এই জ্ঞান ব্যবহার করে এই পরিকল্পনা তৈরি করেছেন।
তিনি কোনো যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক বা ডাক্তার নন এবং এই চ্যালেঞ্জ চলাকালে স্বাস্থ্যকর ডায়েট কী হতে পারে সে সম্পর্কে তিনি কোনো নির্দেশনাও দেননি। তিনি স্বাভাবিকভাবেই এ সময় সুষম ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার কথা বলেছেন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চ্যালেঞ্জটির আরও সহজ কিছু রূপ দেখা যাচ্ছে। যেমন- ৭৫ সফট এবং ৭৫ মিডিয়াম।
এসব চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণকারীরা মাঝে মাঝে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পারেন। তবে প্রতিদিন ব্যায়াম ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে।
'আমার পরিবার ও বন্ধুরা অবাক হয়েছিল'
২৭ বছর বয়সী সোফি ডেকিন্স গত বছর ৭৫ হার্ড সম্পন্ন করেন। তিনি সেসময় লন্ডনের একটি সিনেমা হলে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন।
তিনি বলেন, জীবনের বিভিন্ন কাজের 'শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা' বজায় রাখা নিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন তিনি। এই ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাড়াতে তিনি এই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন।
তিনি তার ডায়েট পুরোপুরি বদলে ফেলেছিলেন। চকলেট ও মিষ্টি খাওয়া একেবারে বাদ দিয়েছিলেন, তবে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া চিনি যেমন- ফল ও মধু খেয়েছেন তিনি।
এছাড়াও সোফি তার সব খাবার বাড়িতে রান্না করতেন এবং একটি অ্যাপ ব্যবহার করে প্রোটিন এবং পানি খাওয়ার পরিমাণ ট্র্যাক করতেন।
এসময় নিজেকে নতুন বই বা অন্য যে কোনো ছোট ছোট পুরস্কার দেওয়া দরকারি বলে মনে করেন তিনি।
তার জন্য সবচেয়ে কঠিন অংশ ছিল সামাজিক জীবনে ভারসাম্য রক্ষা করা। কারণ এর জন্য সাধারণত বাইরে খাওয়া এবং অ্যালকোহল পান করার মতো কাজগুলো করা হয়।
এ বিষয়টি সমাধানে তিনি একটি কাজ করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন: 'আমি যেই সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতাম, তাদের সঙ্গে আমার নেওয়া চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে খোলাখুলি কথা বলে নিতাম। তাই যখন আমি সেখানে [সামাজিক অনুষ্ঠানে] যেতাম, তখন কোনো চাপ থাকতো না। তবে এটি করার জন্য নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হতো আমাকে।'
তিনি জানান, চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করার পরও এখনও তিনি এর কিছু অভ্যাস অনুসরণ করছেন। যেমন- বাইরে না খাওয়া বা অপ্রয়োজনীয় কফি এবং কেক না কেনা। এ অভ্যাসগুলো তাকে 'অনেক টাকা সাশ্রয় করতে সাহায্য করেছে'।
তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন এসেছে, তা সম্ভবত একটি মানসিকতার পরিবর্তন। আমি এই কাজটি করতে পারি তা জেনে নিজের ব্যাপারে যে উত্সাহ পেয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এখন আর কোনো কাজেই সময় বা আত্মবিশ্বাসের অভাবের অজুহাত দেই না আমি।'
চ্যালেঞ্জের সুবিধা ও অসুবিধা
স্ট্রেন্থ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ তানা ফন জিটজেউইটজ বলেন, 'এই চ্যালেঞ্জ সবার জন্য নয়। তাই যারা এ নিয়ে ভাবছেন, তারা যেন বিষয়টি মাথায় রাখেন।'
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'এই চ্যালেঞ্জে শুধু শরীরচর্চার জন্যই নয়, বই পড়ার জন্যও অনেক সময় দিতে হয়। এক দিনে এর সবগুলো শর্ত পূরণ করা বেশ কঠিন কাজ বলেই মনে হয় আমার কাছে।'
তানা বলেন, 'আমি অবশ্যই মনে করি এর কয়েকটি কাজ মানুষ প্রতিদিন করতে পারে। যেমন- প্রতিদিন ৪৫ মিনিট শরীরচর্চা, বেশি পানি খাওয়ার প্রতি সচেতন থাকা এবং স্ক্রিন টাইম কমানো ইত্যাদি। তবে আপনাকে এগুলোর বাইরেও চ্যালেঞ্জের বাকি শর্তগুলোর কথাও মাথায় রাখতে হবে।'
তিনি বলেন, 'আরেকটি দিক হলো অনুপ্রেরণা। বছরের এই সময়ে মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য প্রচুর চাপ থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে বিষয়টি শিথিল হয়ে যায়।'
তিনি পরামর্শ দেন, 'নিজেকে চ্যালেঞ্জ করার একটি পথ বেছে নিন, তবে একইসঙ্গে নিজের প্রতি সদয় থাকুন। যাতে আপনার কাছে শরীরচর্চা ও খাবার শাস্তির মতো বোধ না হয়, বরং প্রতিদিন আনন্দ ও গুরুত্ব নিয়ে এই কাজগুলো করতে পারেন।'
চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, ৭৫ হার্ড উপকারী কি না তা বলা কঠিন।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) স্যাম হোয়াইটম্যান বলেন, 'ক্লিনিক্যাল কোনো গবেষণার মাধ্যমে এটি নির্ধারণ করা হয়নি', তাই এটি কোনোভাবেই আপনার জীবন পরিবর্তন করার দাবি করতে পারে না।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি এটি মানুষের জন্য বাইরে গিয়ে সক্রিয় হওয়ার একটি উপায় হয়, তাহলে আমি পুরোপুরি সমর্থন করি। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় যে এটি সপ্তাহে তিনবার জিমে যাওয়ার বা সপ্তাহে একবার দৌড়ানোর এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার চেয়ে ভালো কি না, তাহলে এর ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না।'
কিছু নির্দিষ্ট মানদণ্ড পূর্ণ করা ৭৫ হার্ডের প্রতিষ্ঠাতা মি. ফ্রিসেলার উদ্দেশ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ- নির্দিষ্ট পরিমাণ ওজন কমানোর দাবি করে কোনো নিয়ম বেধে দেননি তিনি।
এই চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণকারীদের প্রতিদিন নিজেদের ছবি তুলে রাখার ব্যাপারে উত্সাহিত করা হয়। যদিও অংশগ্রহণকারীরা মূলত চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন হওয়ার পর নিজেদের আত্মউপলব্ধির পরিবর্তন নিয়ে বেশি আনন্দিত হন।
ডা. হোয়াইটম্যান এসব মানুষকে এনএইচএস লাইভ ওয়েল ওয়েবসাইট দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। এতে মানসিক স্বাস্থ্য ও পর্যাপ্ত ঘুমের পরামর্শের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর ওজন, ডায়েট এবং ব্যায়াম সম্পর্কে নানা টিপস রয়েছে।