পাল্প সংকটে এখন দেশে ফেলনা কাগজের জন্যও হাহাকার পেপার মিলারদের
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ডলার সংকটের কারণে দেশে ব্যাপকভাবে কমেছে কাগজ তৈরির প্রধান কাঁচামাল পাল্প আমদানি। পাল্পের অভাব এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে, আগামী ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসব এবং ১ ফেব্রুয়ারি থেকে মাসব্যাপী বইমেলা শুরু হওয়ার আগে দেশের কাগজ প্রস্তুতকারীরা উৎপাদন সচল রাখতে এখন ফেলনা বা বর্জ্য কাগজ সংগ্রহ করছেন।
তবে, এই আমদানি সংকট আবার বর্জ্য কাগজ সংগ্রহকারী, ব্যবসায়ী এবং সরবরাহকারীদের জন্য হয়ে উঠেছে আশীর্বাদস্বরূপ। পাল্পের বিকল্প হিসেবে তারা পেপার মিলগুলোতে সেকেন্ডারি বা সহায়ক কাঁচামাল হিসেবে ফেলনা কাগজ সরবরাহের একটি চেইন গড়ে তুলেছেন।
উদাহরণ হিসেবে ঢাকার ধানমণ্ডির স্ক্র্যাপ ডিলার মাসুদুর রহমানের কথাই বলা যেতে পারে। গত কয়েক মাস ধরে তিনি ব্যবসায়ে ব্যাপক বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছেন বলে জানান।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা ব্যবহৃত ও নষ্ট কাগজ সংগ্রহ করে, তাদের কাছ থেকে সাদা বর্জ্য কাগজ কেনেন মাসুদুর। এই সংগ্রহকারীরা কেজিপ্রতি ৪০ টাকায় কাগজ কিনে, তা বিক্রি করে ৫০ টাকায়।
মাসুদুর জানান, গত দুই মাসে নষ্ট বা বর্জ্য কাগজের দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশ বর্জ্য কাগজ সরবরাহকারী সমিতির সভাপতি বাবুল হোসেন জানান, ইদানিং বর্জ্য কাগজের জন্য আরও বেশি দাম দিতে চাইলেও বাসা-বাড়ি থেকে সংগ্রহকারীরা পর্যাপ্ত পরিমাণ কাগজ পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, সংগ্রহকারীরা ছয় মাস আগে পর্যন্ত প্রতিকেজি খবরের কাগজ (ব্যবহৃত) কিনতো ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় এবং সাদা বর্জ্য কাগজের জন্য দিতো ৫০ থেকে ৬০ টাকা। সেখানে এখন প্রতি কেজি খবরের কাগজের দাম দেওয়া হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা এবং সাদা বর্জ্য কাগজ ৭০ থেকে ৮০ টাকা। কিন্তু দাম বেশি দেওয়ার পরেও সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ বর্জ্য কাগজ।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বাবুল হোসেন বলেন, "আমরা আগে প্রতিমাসে ২০০ টন বর্জ্য কাগজ পেতাম, কিন্তু এখন মাসে ১৫০ টন সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
ঢাকার জিগাতলার বর্জ্য কাগজ ও পুরাতন বই সংগ্রহকারী মোকলেসুর রহমান বলেন, তার দৈনিক সংগ্রহ ছিল প্রায় ৪০ কেজি, যা এখন কমে ১৫ থেকে ২০ কেজিতে এসে ঠেকেছে।
বাংলাদেশে মোট পেপার মিল রয়েছে ১০৫টি; কিন্তু এরমধ্যে ৮০টিতেই এখন উৎপাদন হয় না। বাকি ২০টি মিলের জন্য বছরে প্রায় ৪ লাখ টন পাল্পের প্রয়োজন হয়।
কিন্তু বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, দেশের বার্ষিক ৬ থেকে ৭ লাখ কাগজের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন এখন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। আর উৎপাদনে এমন স্থবিরতার মূল কারণ হলো, কাঁচামালের সংকট এবং কারখানায় অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ।
বগুড়ার রাজা পেপার মিলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সোহেল জানান, দৈনিক ৮০ টন বর্জ্য কাগজের চাহিদার বিপরীতে তার মিলে এখন সরবরাহের পরিমাণ দৈনিক মাত্র ১৫ থেকে ২০ টন।
পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের শীর্ষ নেতা মুস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কর্তৃপক্ষ স্বীকার করুক আর না করুক, আমরা তীব্র সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।"
পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে মানের সঙ্গে আপস
আগামী ১ জানুয়ারি ২০২৩- দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে পাঠ্যপুস্তক উৎসব। স্কুলের বাচ্চাদের হাতে হাতে তুলে দেওয়া হবে নতুন বই। কিন্তু চলমান সংকটের কারণে পাঠ্যপুস্তক তৈরিতেও মানের সঙ্গে করতে হচ্ছে আপস। জানান যায়, জাতীয় পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের জন্য পেপার মিলগুলো বর্জ্য কাগজ দিয়ে বি-গ্রেডের সাদা কাগজ তৈরি করছে।
বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "যেহেতু বইগুলো দ্বিতীয় শ্রেণির (বি-গ্রেড) কাগজ দিয়ে ছাপা হবে, তাই ছাপার গুণমানের সঙ্গেও আপস করা হতে পারে।"
সামনের বছর সারাদেশের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে ৩৪ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণের দায়িত্ব রয়েছে বোর্ডের ওপর। অধ্যাপক ফরহাদুল বলেন, এর জন্য প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার টন সাদা কাগজের প্রয়োজন।
"প্রিন্টের গুণমান যেমনটি চেয়েছিলাম, তেমনটি যে হবে না, তা আমি স্বীকার করছি। কিন্তু আপনাকে মানতেই হবে আমরা একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি," বলেন তিনি।
সেইসঙ্গে আরও জানান, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিভিন্ন পেপার মিলে ১১০ টন পুরানো বই এবং নষ্ট কাগজ সরবরাহ করেছে বোর্ড।
মিলার এবং প্রিন্টাররা জানান, এ-গ্রেডের সাদা প্রিন্ট কাগজ তৈরি করতে ভার্জিন পাল্পের প্রয়োজন হয়। তবে, পাল্প সংকটে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের চাহিদার তুলনায় বি-গ্রেডের কাগজপত্রের প্রাপ্যতাও এখন অনেক কম।
পাঞ্জেরী পাবলিকেশন লিমিটেডের প্রকাশক এবং বাংলাদেশ পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক-সেলার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কামরুল হাসান শায়ক জানান, তার কাছে প্রায় ২ কোটি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ কাজের অর্ডার রয়েছে।
কোম্পানি মরিয়া হয়ে তাই ছাপার কাগজের সন্ধান করছে উল্লেখ করে শায়ক বলেন, "আমরা মাত্র ৯৬ লাখ বইয়ের কাজ শেষ করতে পেরেছি। কাগজ হাতে পেলেই বাকিগুলো ছাপা হবে।"
তবে অধ্যাপক ফরহাদুল আশা করছেন, আগামী বছরের ২০ জানুয়ারির মধ্যেই সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া সম্ভব হবে।
"বোর্ড ইতোমধ্যেই ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত উপজেলাগুলোতে প্রায় ৮০ শতাংশ মাধ্যমিক এবং ৬০ শতাংশ প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক পাঠিয়ে দিয়েছে," বলেন তিনি।
কাগজের সংকটের ঘোর বইমেলাতেও
চলমান এই কাগজ সংকট শীঘ্রই উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখছেন না প্রকাশকরা। তারা বলেছেন, এ কারণে এবারের একুশে বইমেলায় আরও কম নতুন বই নিয়ে আসতে যাচ্ছেন তারা।
কামরুল হাসান শায়ক বলেন, বইমেলায় নিয়মিত সময়ে ৩০০ থেকে ৫০০ নতুন বই প্রকাশ করে পাঞ্জেরী। তবে এই সংখ্যাটি এবার মাত্র ৪৫-এ নেমে আসতে পারে।
নালন্দা পাবলিকেশনের রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল বলেন, দাম বেশি হওয়ায় আগের বছরের তুলনায় এবার তাদের নতুন বইয়ের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসতে পারে।
জুয়েল জানান, তার প্রতিষ্ঠান আগে বইমেলায় ৫০ থেকে ৬০টি নতুন বই প্রকাশ করত। "তবে আমরা এবার মাত্র ১৫ থেকে ২০টি নতুন বই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি," যোগ করেন তিনি।