চুইংগাম কেন এখন আর বিদ্রোহের প্রতীক নয়
১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় জন ট্রাভোল্টা ও অলিভিয়া নিউটন-জন অভিনীত মিউজিক্যাল রোমান্টিক কমেডি চলচ্চিত্র 'গ্রিস'। ছবিটিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল চুইংগাম চিবোনো। 'গ্রিস'-এ দেখানো হয় প্রচলিত নিয়ম ভাঙা স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের দল পিঙ্ক লেডিসের গল্প। পর্দায় বারবার দেখানো হয়, তারা সিগারেট খাচ্ছে, কেক, চকলেট খাচ্ছে কিংবা চুইংগাম চিবোচ্ছে। চলচ্চিত্রে নিয়ম ভঙ্গকারীদের পরিচয় হয়ে ওঠে চুইংগাম।
'গ্রিস'-এ চুইংগামের বিষয়টি এতটাই অবিচ্ছেদ্ধ অংশ হয়ে ওঠে যে এক প্রোডাকশন ডিজাইনার দাবি করেন, তিনি অভিনেতাদের জন্য এক লাখ চুইংগাম স্টিক অর্ডার করেছিলেন। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর বিখ্যাত কার্ড নির্মাতা প্রতিষ্ঠান 'টপস' বাবলগামের প্যাকেটের কার্ডে ট্রাভোল্টা ও অলিভিয়ার ছবি ব্যবহারের জন্য দুই অভিনেতাকে এক মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল।
'গ্রিস' এমন এক সময় মুক্তি পায় যখন ১৯৭০-এর দশকে প্রচলিত নিয়মভাঙা ছেলেমেয়েদের ইমেজের অংশ ছিল চুইংগাম। স্কুলপড়ুয়া এসব ছেলেমেয়ে চামড়ার জ্যাকেট পরে, সিগারেট খায়, যৌনতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলে আর ঘন ঘন চুইংগাম চিবোয়। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে 'অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট' ও 'প্রিটি ওমেন' চলচ্চিত্রে চুইংগামকে যৌনতার বিশেষ সংকেত হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেখানেও মার্লন ব্র্যান্ডো ও জুলিয়া রবার্টস অভিনীত চরিত্রগুলো সামাজিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে চুইংগাম চিবোনোর প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছে। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকার দোকানগুলোতে চুইংগাম বিক্রি কমে ৪.৭ শতাংশ। মহামারি এখন সেই ক্রমহ্রাসমান বিক্রির প্রবণতাকে আরো তীব্র করেছে। ভোক্তা-গবেষণা সংস্থা সার্কানার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চুইংগাম বিক্রির সংখ্যা ২০১৮ সালের তুলনায় ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কম। ২০১৬ সালে রিগলি তাদের একটি চুইংগাম কারখানা বন্ধ করে দেয়। গত বছর মন্ডেলেজ কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তার চুইংগাম ব্যবসা বন্ধ করে।
চুইংগামের বিক্রি কমায় মহামারির প্রভাব দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সার্কানায় মিষ্টান্ন পণ্য নিয়ে গবেষণা করা ডেন স্যাডলার বলেন, মানুষ যখন পরস্পরের সংস্পর্শে আসে তখন বেশি চুইংগাম চিবোয়। কিন্তু করোনার সময় কম লোক কাজে গেছে; তাই এ পণ্য কম বিক্রি হচ্ছে। একইসঙ্গে অনলাইন মার্কেটও প্রভাব ফেলেছে এতে। কারণ শুধুই চুইংগাম কিংবা কিট ক্যাটের মতো পণ্যের জন্য মানুষ সুপার শপে যায় না। তবে অন্য কিছুর জন্য গিয়ে বের হওয়ার সময় বিল পরিশোধের কাউন্টারে স্বল্পমূল্যের এসব পণ্য দেখে প্রত্যাখ্যান করতে চায় না। এটা একটা মানসিক বিষয়। কিন্তু অনলাইনে তো সে ব্যবস্থা নেই। মানুষ তো শুধু চুইংগাম কেনার জন্যই ইন্টারনেটে সার্চ করতে যায় না। সার্কানার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মাত্র ২ শতাংশ চুইংগাম অনলাইনে বিক্রি হয়। তবে স্যাডলার বলছেন, চুইংগামের সমস্যা আরো গভীরে। কারণ এটি এখন সাংস্কৃতিক ছাপ হারিয়েছে। এখনকার সংস্কৃতিতে কিশোর-কিশোরীদের অবাধ্যতা প্রদর্শনের জন্য নতুন প্রতীক এসেছে। প্রচলিত নিয়ম ভাঙার ক্ষেত্রে চুইংগাম তার অবস্থান হারিয়েছে।
চুইংগাম কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ১৬ শতকে আমেরিকার অ্যাজটেক জাতি চিকল চিবোত। স্যাপোডিলা গাছ থেকে পাওয়া এক ধরনের রজনই আধুনিক চুইংগামের অনুপ্রেরণা বলে মনে করা হয়। তবে অ্যাজটেকরা মনে করত পতিতাবৃত্তির সঙ্গে চুইংগামের একটা সম্পর্ক আছে।
ট্রিনিটি ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জেনিফার পি. ম্যাথিউস বই লিখেছেন চুইংগামের ইতিহাস নিয়ে। তিনি বলেন, এ দুটি বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক চিন্তার বিষয়। তবে চুইংগাম চিবোনোর সময় মুখের নাড়াচাড়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে বলে অনুমান তার।
তবে যৌনতার সঙ্গে চুইংগামের যে সম্পর্কই থাকুক না কেন, ১৯ শতকের শেষ দিকে যখন চুইংগাম জনপ্রিয়তা পায়, তখনো এই অর্থ টিকে ছিল। ১৮৯৮ সালে উইলিয়াম রিগলি জুনিয়র চুইংগাম কারখানা খোলার পর সংবাদপত্র আর বিলবোর্ডে তার পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতেন। সেখানের অনেক বিজ্ঞাপনই ছিল যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ। নারীদের একটি সাময়িকীতে যেমন অন্তর্বাস পরা মডেল দিয়ে তিনি বিজ্ঞাপন প্রচার করেন।
তার প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকান চিকল কিছু নারীকে নিয়োগ দেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের শহরে শহরে ঘুরে চুইংগাম স্টিক বিলিয়ে দেয়। পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চুইংগাম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। অধ্যাপক ম্যাথিউস বলেন, বয়স্ক ইউরোপিয়ানরা চুইংগামকে 'নোংরা আমেরিকানদের স্বভাব' মনে করত।
যৌনতার বিষয় ছাড়াও মানুষের সামনে মুখ খোলা অবস্থায় দেখার মতো অরুচি নিয়েও ইউরোপে উদ্বেগ ছিল চুইংগাম নিয়ে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য চুইংগাম নিষিদ্ধ করা হয়। শিষ্টাচার বিশেষজ্ঞ এমিলি পোস্ট ১৯৩৫ সালে এক কলামে লেখেন, রাস্তায় কোনো নারীকে চুইংগাম চিবোতে কিংবা সিগারেট খেতে দেখা ছিল অকল্পনীয় বিষয়। চুইংগাম নিয়ে তার বিরোধিতা প্রসঙ্গে এমিলি বলেন, এটি মুখকে কুশ্রী করে এবং বিরক্তিকর শব্দ তৈরি হয়।
তবে চুইংগামের সঙ্গে বিদ্রোহের সংযোগ একসময় হলিউডের পর্দায় উঠে আসে। তার একটি কারণ হতে পারে, সরাসরি যৌন দৃশ্য দেখানোর চেয়ে যৌনতার প্রতীক হিসেবে চুইংগামের ব্যবহার ছিল কম বিতর্কিত।
১৯৬৮ সাল পর্যন্ত হলিউডের চলচ্চিত্র নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হেইস কোডে 'অশালীন নগ্নতা' নিষিদ্ধ ছিল। এই বিধি উঠে যাওয়ার পরও অভ্যাসের বশে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রে খুব কম যৌনতা প্রদর্শিত হতো। চলচ্চিত্র প্রযোজকদের কাছে চুইংগাম ছিল বিদ্রোহের তথা প্রচলিত নিয়ম ভাঙার একটি সুবিধাজনক প্রতীক, যা আসলে অতটা স্ক্যান্ডাল তৈরি করে না।
ইথাকা কলেজের স্ক্রিন-স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ট্রপিয়ানো বলেন, চলচ্চিত্রে গ্ল্যামারাইজড করার সঙ্গে ভদ্র সমাজে চুইংগামের অস্বীকৃতির সম্পর্কের একটিই অর্থ দাঁড়ায়: চুইংগাম একটি 'কুল' বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৯০-এর দশকের চলচ্চিত্র 'ক্লুলেস'-এ অ্যালিসিয়া সিলভারস্টোন শের নামক চরিত্রে অভিনয় করেন। এতে দেখানো হয়, শের-এর উচ্চারণে উপত্যকার মেয়েদের মতো টান আছে এবং দামি জামাকাপড়ে পূর্ণ একটি আলমারি আছে তার। সেখান থেকে শের চুইংগাম বের করে কথা বলার সময় তার আঙুলের মাঝখানে রাখে।
তবে এখন স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে যৌনতা এমনভাবে প্রদর্শিত হয় যে চুইংগামকে আর ততটা নিষিদ্ধ কিছু মনে হয় না। এছাড়াও প্রত্যেক প্রজন্মের বিদ্রোহের ভিন্ন প্রতীক থাকে। এখন যেমন ভ্যাপিং। আধুনিক সংস্কৃতিতে সিগারেটের স্থান দখল করেছে এই ভ্যাপিং।
সান দিয়েগো ইউনিভার্সিটির যোগাযোগবিষয়ক অধ্যাপক সুজানা স্টার্ন বলেন, নেটফ্লিক্স ও টিকটকের মতো মাধ্যমের কারণে গণমাধ্যমের এতটাই ব্যক্তিকরণ হয়েছে যে, আগের মতো সবার কাছে কোনো প্রতীককে একইভাবে দেখা হবে না। সম্পূর্ণভাবে না হলেও এখন মদ্যপান মূলধারায় প্রচলিত একটি বিষয়। এছাড়া যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনাও মানুষের কাছে বিশেষ জঘন্য নয়।
বিদ্রোহ অবশ্যই এখনো বিদ্যমান, কিন্তু মানুষের কাছে এখন এটি প্রকাশ করার অনেক উপায় রয়েছে। ফলে একজন ব্যক্তির কাছে যা বিরক্তিকর মনে হয়, তা সহজেই অন্যের কাছে স্বাভাবিক হতে পারে। বিলি আইলিশ যেমন বছরের পর বছর ধরে চুল সবুজ করে চলেছেন। অথচ তিনি গণমাধ্যমের বেশি মনোযোগ পেয়েছেন নিজের চুল প্রচলিত স্বর্ণকেশী রঙ করে। একসময় পুরুষের নেইলপলিশকে সমকামী হওয়ার স্পষ্ট বার্তা মনে করা হলেও এখন অনেক র্যাপ গায়ক ও অভিনেতা নেইলপলিশ ব্যবহার করছেন।
সে হিসেবে চুইংগাম বিক্রি কমে যাওয়া হয়তো বিকল্প উপায় বিদ্যমান থাকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফল। এখন বিদ্রোহ প্রকাশের একক কোনো মাধ্যম নেই। তাই এই সংস্কৃতিতে নিয়মভাঙার প্রচলিত প্রতীকও তার আগের ক্ষমতা হারিয়েছে।