যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠা কে এই কমেডিয়ান রাসেল ব্র্যান্ড?
ব্রিটিশ কমেডিয়ান ও ব্রডকাস্টার রাসেল ব্র্যান্ড যেন এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। তিনি একদিকে ২০০০ দশকের শেষদিকে পপ সংস্কৃতি প্রচারে যেমন অনবদ্য অবদান রেখেছেন। অন্যদিকে আবার চার নারীকে যৌন হয়রানির অভিযোগও বর্তমানে মোকাবিলা করছেন। খবর বিবিসির।
৪৮ বছর বয়সী ব্র্যান্ডের জন্ম ইংল্যান্ডের এসেক্সে। তিনি মূলত 'বিগ ব্রাদার্স বিগ মাউথ' শো উপস্থাপনা করে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। টিভি শো-এর জগত পেরিয়ে কাজ করেছেন সিনেমাতেও।
বর্তমানে ব্র্যান্ড রাজনীতি এবং সমাজ নিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন। করোনাকালীন সময়ে ইউটিউব ও রাম্বলে ভিডিও পোস্ট করে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়েও আলোচনা করেছেন।
ব্র্যান্ড ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন মূলত একজন স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হিসেবে। প্রথমে ২০০০ সালের দিকে হ্যাকনি এমপায়ারে এবং পরবর্তী সময়ে এডিনবার্গ ফ্রিঞ্জে তিনি পারফর্ম করতেন।
স্ট্যান্ড আপ কমেডিতে ব্র্যান্ডের বেশিরভাগ কন্টেন্টই থাকতো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে। তিনি সবসময়ই নিজের অবৈধভাবে ড্রাগ সেবন ও যৌন আসক্তির ব্যাপারে প্রকাশ্যে কথা বলতেন। এমনকি পরবর্তী সময়ে তার লেখা আত্মজীবনী 'মাই বুকি উক' এও এই বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে স্ট্যান্ড আপ কমেডির পাশাপাশি ব্র্যান্ড এক্সএফএম এবং বিবিসি ৬ মিউজিকে রেডিও প্রোগ্রাম হোস্ট করতেন। তিনি সর্বপ্রথম বড় বিতর্কে জড়ান ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার হামলাকে কেন্দ্র করে।
হামলার ঠিক পরের দিন ব্র্যান্ড ওসামা বিন লাদেনের মতো পোশাক পরে কাজে আসেন। আর এতে বিব্রত হয়ে এমটিভি কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন।
যদিও ব্র্যান্ড পরবর্তীতে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি ঐ সময়টাতে নেশায় বুঁদ হয়ে এমনটা করেছিলেন। তবে সেটা যাই হোক; এমন সব কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে তিনি সকলের দৃষ্টি বেশ ভালোই আকর্ষণ করেছিলেন।
ব্র্যান্ডের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০০০ এর দশকের মাঝের সময়টাতে। তখন তিনি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় 'বিগ ব্রাদার' রিয়েলিটি সিরিজের 'বিগ ব্রাদার বিগ মাউথ' শো উপস্থাপনা করেন। টেলিভিশনের পর্দায় তার ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্য এবং তার কণ্ঠস্বর উপেক্ষা করা দর্শকদের জন্য ছিল অনেকটা অসম্ভব।
ব্র্যান্ডের ন্যারো জিন্স, গাঢ় রঙের পোশাক ও বড় চুল যেন তৎকালীন সময়ের পপ সংস্কৃতির পরিচায়ক। তার এই গথিক লুককে অনেকেই সঙ্গীতশিল্পী এমি ওইয়ানহাউজের সাথে তুলনা করতেন; যিনি ২০১১ সালে অ্যালকোহল পানে বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছেন।
ক্যারিয়ারের প্রথম থেকেই ব্র্যান্ডের ব্যক্তিত্ব নিয়ে সাধারণ দর্শকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা ছিল। একদিকে বহু দর্শক যেমন তাকে পছন্দ করতেন; ঠিক তেমনি বহু দর্শক তাকে অপছন্দও করতেন।
ব্র্যান্ড মূলত ক্যরিয়ারে সফলতা লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে 'বিগ ব্রাদারস বিগ মাউথ' শো-এর ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। এর কারণেই তিনি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে নামীদামী উপস্থাপকদের একজন হয়ে উঠেছিলেন।
ব্র্যান্ড ক্যরিয়ারে এনএমি, এমটিভি ও ব্রিট অ্যাওয়ার্ড এ উপস্থাপনা করেছেন। তিনি প্রথমে 'বিবিসি রেডিও ৬ মিউজিক' এ থাকলেও পরবর্তীতে আরও জনপ্রিয় 'রেডিও ২' এ যুক্ত হয়েছিলেন। সেখানে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় দীর্ঘ দুই ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতেন তিনি।
পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই বিতর্কিত সব কর্মকাণ্ড করে আলোচনায় ছিলেন ব্র্যান্ড। এরমধ্যে ২০০৮ সালে অভিনেতা অ্যান্ড্রু শ্যাক্সের সাথে কেলেঙ্কারি বহুল আলোচিত; যা বিনোদন জগতে শ্যাক্সগেট নামে পরিচিত।
মূলত ঘটনার শুরু ব্র্যান্ডের টিভি শো এ শ্যাক্সের সাক্ষাৎকার প্রদানের ইস্যু ঘিরে। একটি নতুন টিভি সিরিজের প্রমোশনের জন্য শ্যাক্সের ঐ সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো কারণে তিনি তা দেননি। আর তাতেই ব্র্যান্ড ও শো এর আরেক অতিথি জনাথান রস অনুষ্ঠানের মাঝে এক ভয়েজ মেইলে শ্যাক্সের পরিবারকে জড়িয়ে বেশ আপত্তিকর কথা বলেন।
ঘটনাটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে ৪০ হাজারেরও বেশি দর্শক এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। বিবিসি ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ফোনকলটিকে 'চরম আপত্তিকর' বলে অভিহিত করা হয়। একইসাথে অফকমের পক্ষ থেকে কর্পোরেশনকে ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড জরিমানা করা হয়।
ঘটনার জেরে ব্র্যান্ডকে শো-এর উপস্থাপনা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর রসকে ১২ সপ্তাহের জন্য বিবিসি থেকে সাসপেন্ড করা হয়। আর এই 'রেডিও ২' এর কন্ট্রোলার লেসলি ডগলাস পদত্যাগ করেন।
বিবিসি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হলেও ব্র্যান্ডের ক্যারিয়ার থেমে থাকেনি। বরং তার জনপ্রিয়তা যেন আরও বাড়তে থাকে।
পরবর্তীতে ব্র্যান্ড নিজেকে একজন অভিনেতা হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি 'ফরগেটিং সারাহ মার্শাল', 'রক অফ এইজেস', 'সেন্ট ট্রিনিয়ান্স' ছাড়াও বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেন।
২০০৯ সালে ব্র্যান্ডের সাথে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত পপ স্টার কেটি পেরির পরিচয় ঘটে। মূলত ব্র্যান্ডের অভিনীত সিনেমা 'গেঁট হিম টু দ্য গ্রিক' এ এই পপ তারকা একটি ক্যামিও করেছিলেন।
সেই থেকে ব্র্যান্ড ও কেটির প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে ভারতে এই দুই তারকা বিয়ে করেন। যদিও তাদের সম্পর্ক খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দুই বছর পরেই তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
এই সময়টাতে ব্র্যান্ড কাজের পাশাপাশি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেতে থাকেন। নানা টক শো তেও তিনি উপস্থিত হয়ে সমসাময়িক বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে থাকেন।
নিউজনাইট এ উপস্থিত হয়ে উপস্থাপক জেরেমি প্যাক্সম্যানের প্রশ্নের জবাবে ব্র্যান্ড জানান, তিনি সাধারণ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন না। কেননা 'প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা রাজনৈতিক শ্রেণীর মিথ্যা আশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণায়' তিনি ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্থ। এমনকি সাধারণ মানুষকেও তিনি ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেন।
২০১২ সালে ব্র্যান্ড ড্রাগ ও অ্যালকোহল আসক্তি নিয়ে আলোচনা করতে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটির সেশনে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি ঠাট্টা করে বেশকিছু কথা বললে একজন সংসদ সদস্য বলতে বাধ্য হন যে, "এটি একটি সেশন, কোন ভ্যারাইটি শো-এর জায়গা নয়।"
রাজনীতি নিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে থাকলেও ব্র্যান্ড কখনো নিজে নির্বাচন করার চেষ্টা করেনি। বরং তিনি নিজের আদর্শ অনুযায়ী বিকল্পধারার সরকারের ধারণা প্রচার করেছেন। একইসাথে ভোটারদের কাছে জনপ্রতিনিধি বেঁছে নেওয়ার জন্য অল্প সংখ্যক চয়েজ থাকে বলে অভিযোগ করেন।
পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই ব্র্যান্ড বিতর্ককে সাথে নিয়ে এগিয়েছেন। সম্প্রতি সানডে টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নানা সময়ে মোট চারজন নারীকে ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এরমধ্যে একজন নারী দাবি করেছেন, ব্র্যান্ডের সাথে তার ১৬ বছর বয়সে তিন মাসের একটি সম্পর্ক ছিল। তখন তিনি ব্র্যান্ড কর্তৃক মানসিক ও যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন।
যদিও ব্র্যান্ড এক ইউটিউব ভিডিওতে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, "কর্মজীবনের সেই সময়টাতে কিছুটা লাগামছাড়া ছিলাম। তবে সেই অশ্লীলতার সময়ে আমার সম্পর্কগুলোর সবই সম্মতিমূলক ছিল। তখন আমি এসব বিষয় নিয়ে বেশ স্বচ্ছ ছিলাম, খুব স্বচ্ছ।'
২০১৩ সালে জিকিউ অ্যাওয়ার্ডের স্পসর হুগো বসের নাজিদের জন্য ইউনিফর্ম তৈরির ইতিহাস সামনে এনে ব্র্যান্ড কঠোর সমালোচনা করেন। যার ফলশ্রুতিতে তাকে অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
২০১৭ সালে ব্র্যান্ড ফের রেডিও প্রোগ্রাম উপস্থাপনায় ফিরে আসেন। রেডিও এক্স (প্রাক্তন এক্সএফএম) এ সাপ্তাহিক একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা শুরু করেন তিনি; যেটি মাত্র এক বছরেরও কম সময় চলেছে।
ব্র্যান্ডের প্রথম আত্মজীবনী বেশ সফল হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে তিনি বইটির দ্বিতীয় খণ্ড হিসেবে 'বুকি উকি ২' প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ড্রাগ আসক্তি থেকে সেরে ওঠার গল্প তুলে ধরেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ২০২০ সালে করোনা মহামারী শুরুর দিকে ব্র্যান্ড নিজেকে নতুনভাবে হাজির করেন। তিনি তখন ইউটিউবে করোনা মহামারী ঘিরে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে আলাপ করতে থাকেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বর্তমানে বেশ সরব ব্র্যান্ড। তার ইনস্টাগ্রামে চার মিলিয়ন, টিকটকে ২.২ মিলিয়ন ও ইউটিউবে ৬.৫৯ মিলিয়য় ভক্ত যুক্ত রয়েছে।
কোভিডকালীন সময়ে ভুল তথ্য পরিবেশনের দায়ে ব্র্যান্ডের একটি ভিডিও ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। পরবর্তীতে তিনি 'রাম্বেল' নামের নতুন একটি প্ল্যাটফর্মে 'স্টে ফ্রি উইথ রাসেল ব্র্যান্ড' নামের একটি ডেইলি লাইভ শো শুরু করেন।