হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে
আহমদ ছফা লিখেছিলেন 'গাভী বিত্তান্ত'। প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। এরপর সংস্করণ হয়েছে অনেক। প্রকাশনী বদলে গেছে। নিজেরা গাভী বিত্তান্তের চরিত্র হয়েও চোরাই প্রকাশনাতে গেছেন কেউ কেউ। কারণ এর জনপ্রিয়তা।
'গাভী বিত্তান্ত'র ২৯ বছর পর প্রকাশ হচ্ছে 'ছাগল বিত্তান্ত'। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বৃত্তান্তের শেষ নেই। ওই যে একটা গান আছে না, 'এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল, সবই ভুল'-এর মতো ফেসবুকের পাতায় পাতায় আজ যা লেখা সে ছাগল, সবই ছাগল।
এই ছাগল বাঙালির অতিশয় প্রিয় এক শব্দ। কথায় কথায় আমরা ছাগলের উদাহরণ টানি। কাউকে কাউকে কখনো কখনো যে ছাগল বলা হয়, সেটা একটু বকুনি হলেও আসলে ভালোবাসারই প্রকাশ। দূরবর্তী কাউকে ছাগল বলা হলেও সেটা শুধুই সমালোচনা। এর মধ্যে ভয়ঙ্কর গালিগালাজের তেমন কিছু নেই।
বাঙালি ছাগলের দাড়ি নিয়েও টানাটানি করে। সেটাও অবশ্য ভালেবাসার প্রকাশ। কাউকে ছাগলের দাড়িতে হাত বোলাতে দেখলে অবশ্যই মনে হবে, পরম মমতায় তিনি ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছেন। তবে, বাংলা সিনেমার কল্যাণে নিজের ছাগলদাড়িতে হাত বোলানো লোকটাকে অবশ্য মন্দ বলেই মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ। ছাগলদাড়ির ভালো মানুষগুলোও এভাবে একপক্ষীয় ন্যারেটিভে সাধারণ্যে মন্দ লোক হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন।
সে যা-ই হোক, ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা কিন্তু গর্ব করার মতো। স্বয়ং মন্ত্রীর ভাষ্যে জানা যায়, ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ। শুধু তা-ই নয়, ছাগলের মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ সপ্তম।
গত বছর এরকম সময়ে অর্থমন্ত্রী ছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। তাঁর দেওয়া যে বাজেটে আমরা এখনো চলছি, সেই বাজেট বক্তৃতায় তিনি জানিয়েছিলেন, ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ, ছাগলের মাংস উৎপাদনে সপ্তম। এরপর আমাদের উন্নতি হয়ে থাকলেও হয়ে থাকতে পারে, অবনতি নিশ্চয় হয়নি।
কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ছাগলের দাম বেড়েছে বেশ। বিশেষ করে কোরবানীর জন্য বিশেষ ধরনের ছাগল তো বটেই। এমনকি এ বছর বাজারে এমন ছাগলও বিক্রি হয়েছে যার আর দ্বিতীয় কোনো পিস নেই।
সেই ছাগলটি নিয়েই আজ তুলকালাম কাণ্ড, নেট দুনিয়া ত বটেই; গণমাধ্যমেও তোলপাড়।
ছাগলটির নাম নাকি 'মস্তান'। আমরা এটা দ্বিতীয় কোনো সূত্রে যাচাই করতে পারিনি। ছাগলটির ক্রেতা যুবকটিকে দেখেও 'মস্তান' বা 'মাস্তান' মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে যেভাবে তিনি সবকিছু কাঁপিয়ে দিয়েছেন, সেটা বয়োজ্যেষ্ঠরা বলছেন, ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া 'রংবাজ' চলচ্চিত্রের চেয়েও কম কিছু না।
ক্রেতা প্রসঙ্গে পরে আসি। আগে ছাগল প্রসঙ্গ। কারণ ছাগলটির অস্তিত্বই যদি না থাকত, তাহলে এত কথা উঠত না। আমাদেরও 'ছাগল-মাহাকাব্য' নিয়ে বসতে হতো না।
ফার্স্ট থিংস ফার্স্ট।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনের একটু আমরা পড়ে নিতে পারি: যে ছাগলের দাম নিয়ে এত জল্পনা কল্পনা, তা হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাতের ছাগল, বলেছেন সাদিক এগ্রোর মালিক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন।
এ জাতের নাম 'বিটল' এবং "বাংলাদেশে এটি এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ছাগল," বলেন তিনি।
আলোচিত ওই ধূসর বাদামি রঙের ছাগলটির ওজন ১৭৫ কিলোগ্রাম এবং উচ্চতা ৬২ ইঞ্চি। মি. হোসেন জানান, "বিরল প্রজাতির এই ছাগল বাংলাদেশে এখন একটিই আছে।"
এটি আমদানি করা হয়েছিলো কিনা জানতে চাইলে মি. হোসেন জানান, আজ থেকে দুই মাস আগে ছাগলটি যশোরের একটি হাট থেকে ক্রয় করা হয়েছিলো।
যশোরের হাটে এই ছাগল কীভাবে এলো? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমরা তা জানি না। তবে এরকম ছাগল, বড় বড় গরু প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রামে গঞ্জে, হাটেই বিক্রি হয়। হাট থেকে কিনে এনে আমরা সেগুলো লালন-পালন করে বিক্রি করি।"
"আমাদের কাছে যখন তথ্য আসছে, আমরা সাথে সাথে লোক পাঠিয়ে টাকা দিয়ে এটা কিনে নিয়ে আসছি। কারণ আমাদের কাছে ছাগলটাকে খুব ভালো লেগেছে।"
সাদিক অ্যাগ্রোর মালিকের দাবি, তাদের ভালো লাগা ছাগলটি বাংলাদেশে এক পিসই আছে। মানে তিনি বিনে পয়সায় আমাদের এক পরাবাস্তব জগতে নিয়ে যাচ্ছেন। তার সৌজন্যে আমরা এমন একটি ছাগলের সন্ধান পেয়েছি- বংশ গরিমায় সে অতি উচ্চ হলেও লালসালুর মজিদের মতো কোথা থেকে তার আগমন কেউ জানেন না। তার কোনো পূর্বপুরুষ বা অতীত নেই, বর্তমানে সে একা, আর ভবিষ্যতে জীবনানন্দের ভাষায় 'যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ'।
ছাগল প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের নাম উচ্চারণে কেউ কেউ হয়তো ভ্রুঁ কুঁচকাচ্ছেন। সত্যি বলছি, জীবনানন্দ দাশ ছাগল নিয়েও কবিতা লিখেছেন। আসলে ছাগল নিয়ে না। বলা ভালো তাঁর কবিতায় ছাগলও এসেছে এভাবে:
'ভোরবেলা পাখিদের গানে তাই ভ্রান্তি নেই,
নেই কোনো নিষ্ফলতা আলোকের পতঙ্গের প্রাণে।
বানরী ছাগল নিয়ে যে ভিক্ষুক প্রতারিত রাজপথে ফেরে-
আঁজলায় স্থির শান্ত সলিলের অন্থকারে-
খুঁজে পায় জিজ্ঞাসার মানে।'
প্রসঙ্গ অবশ্যই ভিন্ন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর কবিতায় ছাগলকে স্থান দিয়ে লিখেছেন:
'বাহিরের দিকে মরিয়াছি যত ভিতরের দিকে তত
গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু ছাগলের মত।'
নজরুলে সৌভাগ্য যে তখনো পশুপ্রেমিরা অত সরব হননি। হলে এভাবে তুচ্ছার্থে গরু-ছাগল, বিশেষ করে ছাগলের অবতারণায় তাঁর বিরুদ্ধে আরো একটা জেহাদ শুরু হয়ে যেত।
ছাগল নিয়ে রবি ঠাকুর কিছু লিখেছেন কিনা জানা নেই। তবে যুক্তিবিদ্যার একটা তথাকথিত গল্প ছোটবেলা থেকে আমরা সবাই শুনে এসেছি। একটু-আধটু পড়ালেখা করেছেন, এমন যে-কেউই দাড়িবিষয়ক গল্পটা জানেন।
যুক্তিবিদ্যার সে প্রসঙ্গে আর না যাই। বরং ছাগল-সাহিত্য প্রসঙ্গে আরো একটু কথা বলা যায়। ছাগল-সাহিত্য মানে ছড়া-কবিতায় যেভাবে আমরা ছাগলকে পেয়েছি।
এক্ষেত্রে সুকুমার রায়ের চেয়ে আর কে এগিয়ে থাকবেন! ছাগলের দাড়ি নিয়ে রায়বাবু লিখেছেন:
'পাঁড়েজির বৃদ্ধ ছাগল যেদিন শিং নাড়িয়া দড়ি ছিঁড়িয়া ইস্কুলের উঠানে দাপাদাপি করিয়াছিল, আর শ্যামলালকে তাড়া করিয়া খানায় ফেলিয়াছিল, তাহার পরদিন ভারতবর্ষের বড় ম্যাপের উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা বাহির হইল—
পাঁড়েজির ছাগলের একহাত দাড়ি,
অপরূপ রূপ তার যাই বলিহারি!
উঠানে দাপটি করি নেচেছিল কাল
তারপর কি হইল জানে শ্যামলাল।'
আরও আছে তাঁর। তাই আরো একবার সুকুমার রায় পাঠ:
'ওরে ছাগল, বল্ত আগে
সুড়সুড়িটা কেমন লাগে?
কই গেল তোর জারিজুরি
লম্ফঝম্ফ বাহাদুরি ।
নিত্যি যে তুই আসতি তেড়ে
শিং নেড়ে আর দাড়ি নেড়ে,
ওরে ছাগল করবি রে কি?
গুঁতোবি তো আয় না দেখি ।'
আমাদের, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মনকে নির্মল করা আরেকজন হলেন সুনির্মল বসু। 'ভাগলপুরের ছাগল'নামে তাঁর একটি ছড়া এ সুযোগে আমরা পড়ে নিতে পারি:
'ভাগলপুরের ছাগল হঠাৎ
পাগল হয়ে যায়,
শিঙ বাগিয়ে লাগায় তাড়া
সামনে যারে পায়।'
শুধুই কি সুকুমার রায় আর সুনির্মল বসু! যাঁর হাত ধরে বাংলা কবিতা অনেকটা আধুনিকতার যুগে প্রবেশ করেছিল, সেই স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছেন:
'রসভরা রসময় রসের ছাগল।
তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।'
এবার ক্রেতা প্রসঙ্গ। ফেসবুকে ছাগলসহ তার সেলফি এবং তার বা তাদের সব পশুর রাজকীয় আগমনের ভিডিও এখন ভাইরাল।
এই ভাইরাল হওয়াই তার জন্য কাল হয়েছে।
তবে সাদিক অ্যাগ্রোর দাবিতে আরেক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছে, ছাগলটি আসলে বিক্রিই হয়নি। ছাগলটির জন্য ১ লাখ টাকা বুকিং মানি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্রেতা ছাগলটি সংগ্রহ করেননি। তাই এখন তাদের খামারেই আছে ওই ছাগল। সঙ্গে তারা এ কথাও বলছেন যে, ছাগলটি ১৫ নয়, ১২ লাখে বিক্রি হয়েছিল।
পনেরো বা ১২ যা-ই হোক, লাখ লাখ টাকায় যারা ছাগল কিনতে পারেন, নিজের সম্মানের স্বার্থে হলেও এনবিআর তাদের আয়ের উৎস নিয়ে নিশ্চয় খোঁজ-খবর করবে। তাতে না ওই ছাগলওলাদের হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়! তখন হয়ত গোটম্যান এবং তার পরিবারকে এই গান গাইতে হবে: হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে।
কিন্তু এ কথাও বলতে হবে গোটম্যান আসলে সত্যিই এক গোট (গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম)। তিনি আরেকবার এমন এক চারণভূমিকে চিনিয়ে দিয়েছেন যেটা শুধুই কালোটাকা আর দুর্নীতির। এসবই হয়তো আমাদের জানা। কিন্তু সময় সময় গোটরা সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। বেনজীরকে দিয়ে সেই নজির আমরা দেখেছি।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।