ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লিখে ওয়েস্ট ইন্ডিজে স্মরণীয় টেস্ট জয় বাংলাদেশের
ভারত সফর থেকে ব্যর্থতার শুরু, এরপর টেস্টে কেবল হেরেই গেছে বাংলাদেশ। বোলিংয়ে চাওয়া মিটলেও ব্যাটিংয়ে হতাশার শেষ ছিল না। ব্যাটিং ব্যর্থতা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অমোঘ নিয়তি। যা জারি থাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও। ব্যাটিং ব্যর্থতাতেই প্রথম টেস্টে হারতে হয় বড় ব্যবধানে। দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসেও ছিল একই চিত্র। কিন্তু এরপরই হাওয়া বদল। নাহিদ রানার আগুনে বোলিংয়ে ক্যারিবীয়দের অল্প রানে গুটিয়ে দিয়ে ব্যাট হাতে লড়ার সাহসও পেয়ে যায় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে আসে রান, পরে বল হাতে তাইজুল ইসলামের স্পিন ভেল্কি। ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লিখে ওয়েস্ট ইন্ডিজে স্মরণীয় এক জয় তুলে নিলো মেহেদী হাসান মিরাজের দল।
জ্যামাইকার স্যাবাইনা পার্কে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১০১ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম টেস্টে হার মানা বাংলাদেশ ঘরের মাঠের দলটির সঙ্গে সিরিজ ভাগাভাগি করলো ১-১ ব্যবধানে। এই জয়ে দীর্ঘ অপেক্ষা ফুরালো তাদের। ১৫ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টেস্ট জিতলো বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০০৯ সালে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে ক্যারিবীয় দীপপুঞ্জে টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় তারা। সেই সফরে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ।
যে টেস্টের প্রথম ইনিংসের পর বাংলাদেশ ছিল কোণঠাসা অবস্থায়, সেই টেস্টের চতুর্থ দিনেই তাদের বিজয় নিশান ওড়ানোর দৃশ্য দেশের ক্রিকেটমোদীদের মনে স্বস্তিই ফেরানোর কথা। কারণ, পাকিস্তান সফরে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে আসার পর থেকে হারের বৃত্তে বন্দী হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। টানা পাঁচ টেস্টে হারের পর জয়ের স্বাদ পেল তারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২২ টেস্টে এটা বাংলাদেশের পঞ্চম জয়, ক্যারিবীয়দের মাঠেই তিনটি টেস্ট জিতলো বাংলাদেশ। রানের হিসেবে বিদেশের মাটিতে এটা তাদের তৃতীয় বড় জয়।
বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের টেস্ট রেকর্ড ভালো নয়, এবার কিছুটা হলেও সেই রেকর্ডে নিজেদের সাফল্যের ঝুলি ভারি করলো তারা। এক বছরে বিদেশের মাটিতে সর্বোচ্চ টেস্ট টেস্ট জিতলো দলটি। পাকিস্তান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর মিলিয়ে তিনটি টেস্ট জিতলো বাংলাদেশ। এর আগে সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল ২টি টেস্ট জয়, যা আসে ২০০৯ সালে। জ্যামাইকা টেস্ট জয়ে দারুণ অধিনায়কত্ব করা মিরাজ বাংলাদেশের পঞ্চম অধিনায়ক, যিনি বিদেশের মাটিতে টেস্ট জিতলেন। আগের চার জয়ী অধিনায়ক হলেন সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মুমিনুল হক ও নাজমুল হোসেন শান্ত।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং ব্যর্থতার বৃত্তেই বন্দী থাকে, ১৬৪ রানে শেষ হয় তাদের ইনিংস। বল হাতে এটা পুষিয়ে নেয় সফরকারী দলটি, নাহিদের দুর্বার বোলিংয়ের সঙ্গে সিরিজ সেরা তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদদের তোপে ১৪৬ রানে অলআউট হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ইনিংসে ১৮ রানে লিড পাওয়া বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ইনিংসে অন্য চেহারায় দেখা যায়। দ্রুত রান তোলার মিশনে সামনে থেকে পথ দেখান অসাধারণ ইনিংস খেলা জাকের আলী অনিক ও মিরাজ।
সাদমানও পান রানের দেখা। এই তিনজনের ব্যাটে সব কটি উইকেট হারিয়ে ২৬৮ রান তোলে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে ১৮ রানে পিছিয়ে থাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৮৭ রান। এই রান তাড়া করে জিততে স্যাবাইনা পার্কের রেকর্ড পাল্টাতে হতো স্বাগতিকদের। এই মাঠে ২৩টি ইনিংসে ২০০'র বেশি রান তাড়ায় কেবল দুবার সফল হয়েছে কোনো দল, সেই দলটি ওয়েস্ট ইন্ডিজই। কিন্তু এই দফায় সফল রান তাড়া করতে পারেনি তারা। ম্যাচসেরা তাইজুল ইসলাম এবং তাসকিন ও হাসানের বোলিং তোপে ১৯৫ রানেই গুটিয়ে যায় ক্যারিবীয়দের ইনিংস।
৫ উইকেটে ১৯৩ রান নিয়ে চতুর্থ দিনের খেলা শুরু করা বাংলাদেশ আরও ৭৫ রান যোগ। যার পুরো কৃতিত্বই দিতে হবে জাকেরকে। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান একাই দলকে এগিয়ে নিয়ে যান। দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে মহাকার্যকর ইনিংস খেলা জাকের ১০৬ বলে ৮টি চার ও ৫টি ছক্কায় ৯১ রান করেন। অভিষেকের পর থেকে টানা তিন টেস্টে পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংস খেলেছেন তিনি। ক্যারিয়ারের প্রথম তিন টেস্টেই পঞ্চাশ ছোঁয়া দ্বিতীয় বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান জাকের। আগের দিন দাপুটে ব্যাটিংয়ে ৩৯ বলে ৭টি চারে ৪২ রান করেন মিরাজ। ৮২ বলে ৭টি চারে ৪৬ রান করেন সাদমান।
লক্ষ্য তাড়ায় শুরুটা ভালো ছিল না ওয়েস্ট ইন্ডিজের। দলীয় ২৩ রানেই প্রথম উইকেট হারায় তারা। এরপর তাইজুল, তাসকিন, হাসানদের বোলিংয়ের সামনে নিয়মিত ধারায় উইকেট হারাতে থাকে স্বাগতিকরা, যা থামে ১৮০ পেরিয়ে। এর মাঝেও অবশ্য দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক ক্রেইগ ব্রাথওয়েট, ৬৩ বলে ৪৩ রান করেন তিনি। হাফ সেঞ্চুরি করেন কাভেম হজ, ৭৫ বলে ৫৫ রান করেন তিনি। এ ছাড়া কেসি কার্টি ১৪, জাস্টিন গ্রিভস ২০ ও জশুয়া ডি সিলভা ১২ রান করেন। তাদের বাকি ছয় ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কের রান করতে পারেননি।
স্পিন ভেল্কিতে ঘরের মাঠের দলটিকে কাবু করা তাইজুল ১৭ ওভারে ৫০ রান দিয়ে নেন ৫টি উইকেট। টেস্টে ১৫তম বারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেটের দেখা পেলেন তিনি, বিদেশের মাটিতে পঞ্চম। এই রেকর্ডে সাকিবকে ছুঁয়ে ফেলেন তাইজুল, সাকিবও বিদেশের মাটিতে পাঁচবার ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন। তাসকিন ১০ ওভারে ৪৫ রানে পান ২ উইকেট। হাসানের শিকারও ২ উইকেট। আগের ইনিংসে গতির ঝড় তুলে ৫ উইকেট নেওয়া নাহিদ দ্বিতীয় ইনিংসে পান একটি উইকেট।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ১৬৪
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস: ১৪৬
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস: ২৬৮
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংস: ১৮৫ (লক্ষ্য ২৮৭), (ব্রাথওয়েট ৪৩, কার্টি ১৪, হজ ৫৫, গ্রিভস ২০, ডি সিলভা ১২; তাইজুল ৫/৫০, তাসকিন ২/৪৫, হাসান ২/২০, নাহিদ ১/৩২)।
ফল: বাংলাদেশ ১০১ রানে জয়ী
ম্যাচসেরা: তাইজুল ইসলাম
সিরিজ: ১-১ ব্যবধানে ড্র
সিরিজ সেরা: তাসকিন আহমেদ ও জেডেন সিলস