গণঅভ্যুত্থানে রিকশাচালকের মৃত্যু: অজানা ব্যক্তির মামলা দুর্দশা বাড়াল ভুক্তভোগী পরিবারের
কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন গত ১৯ জুলাই ঢাকার শান্তিনগরের বটতলা এলাকায় পুলিশের গুলিতে মারা যান রিকশাচালক কামাল মিয়া। এ ঘটনায় জুলাই মাসেই বাদী হয়ে পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন কামাল মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন।
কামালের মৃত্যুর ঘটনায় পল্টন থানায় দায়ের করা হত্যামামলায় এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকতসহ আরও বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা।
তবে, রিকশাচালক কামাল মিয়াকে হারিয়ে তার পাঁচ সদস্যদের পরিবার এখন দিশেহারা। স্বামীর বিচারের চাইতে সংসারের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্ত্রী ফাতেমা খাতুন।
আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের ছোট চাকরিতে চারজনের সংসারের খরচ চালানো মুশকি বলে জানান ফাতেমা। এদিকে, মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে যোগ হয়েছে উটকো এক মামলা।
সম্প্রতি কামাল মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন জানতে পেরেছেন, গত ৩০ অক্টোবর কে বা কারা তার স্বামী হত্যার ঘটনায় বাদী হয়ে হয়রানির উদ্দেশ্যে ২৮১ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও গণপূর্ত বিভাগের (পিডব্লিউডি) ১৬ কর্মকর্তাকে।
ফাতেমা খাতুন বলেন, "আমার স্বামীর মারা যাওয়ার ঘটনায় একটি মামলা আছে। এরমাঝে শুনি, কে এম শাহিরয়ার শুভ নামে কেউ একজন আদালতে আরেকটি মামলা করেছেন। আমি শাহরিয়ার শুভ নামে কাউকে চিনি না। তিনি আমাদের পরিবার-স্বজন কেউ নন। তিনি কেন আমাদের হয়ে আরেকটি মামলা করবেন?"
"মামলার কয়েকজন আসামি আমাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছেন, তাদেরও হয়রানি করা হচ্ছে," যোগ করেন ফাতেমা।
কামাল মিয়ার চার ছেলে-মেয়ে। তারা হলেন– আনিকা আক্তার (২১), সুরভী আক্তার (১৮), সুরাইয়া আক্তার (১৬) ও ইয়াছিন (১০)। আনিকা রামপুরায় একটি মাদ্রাসায় পড়েন। সুরাইয়া সেগুনবাগিচায় বেগম রহিমা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। ইয়াছিনও একটি মাদ্রাসায় পড়ছে। বাবাকে হারিয়ে তারা এখন অথৈ সাগরে।
সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে সুরাইয়া জানায়, ১৯ জুলাই সন্ধ্যার পরপরই একটি ছেলে এসে বলল, "বাবাকে গুলি করা হয়েছে। দৌড়ে বটতলায় গিয়ে দেখি রক্তভেজা অবস্থায় বাবাকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় তুলছেন দুইজন লোক। কান্না করতে করতে বাবার নিথর দেহ দেখে তাদের বললাম, 'আংকেল আমি ওনার মেয়ে। আমাকে সঙ্গে যেতে দেন।' তারা কোনো কথা না শুনে দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন। আমার চোখে এখনও বাবার রক্তভেজা মুখটা ভেসে ওঠে।"
কে এই অজানা অভিযোগকারী?
তদন্তে জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্র ধরে জানা গেছে, আদালতে করা মামলার বাদী কে এম শাহরিয়ার শুভ, গণপূর্তের এক সময়ের ঠিকাদার কে এম নাজমুল ইসলামের আপন ছোট ভাই।
গণপূর্ত অধিদপ্তর ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক রফিক হাওলাদার বলেন, কে এম নাজমুল ইসলাম দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে সম্প্রতি বহিষ্কৃত হলেও তিনি মূলত আওয়ামী লীগের ছত্রছায়াতেই পূর্ত অধিদপ্তরের ঠিকাদারির কাজ করতেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে সাবেক সচিব ওয়াসি উদ্দিনের নাম ভাঙ্গিয়ে ঠিকাদারি করতেন তিনি।
রফিক হাওলাদার বলেন, "বহিষ্কৃত হওয়ার পরেও তিনি (নাজমুল) তার ভাইয়ের মাধ্যমে মামলা দায়ের করেছেন। গণঅভ্যুত্থানে কামাল উদ্দিন নামে এক রিকশাচালককে হত্যার ঘটনায় গণপূর্তের ১৬ জন কর্মকর্তা-প্রকৌশলীসহ ২৮১ জনের নামে মামলা দিয়েছেন তিনি। মূলত, এসব কর্মকর্তাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে ও চাঁদার দাবিতেই মামলাটি করা হয়েছে।"
"ঠিকাদার নাজমুল ইসলাম তার ছোট ভাই কে এম শাহরিয়ার শুভকে দিয়ে মামলাটি করায়, হত্যার শিকার কামাল উদ্দিনের পরিবারও এ বিষয়ে বিশেষ কিছু জানে না," বলেন রফিক।
ধানমণ্ডি-১৫ নম্বরের যে বাসার ঠিকানা ব্যবহার করে মামলাটি করেছেন কে এম শাহরিয়ার শুভ, ওই বাসায় গিয়ে জানা যায়– তিনি কখনোই ওই বাসায় থাকতেন না। পরিচয় গোপন করে মানুষকে হয়রানি করতে মামলার আরজিতে এই ঠিকানা ব্যবহার করেছেন।
বাসার মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, "শাহরিয়ার শুভ নামে কেউ কখনো এই বাসায় থাকেননি। তবে, কিছু লোকজন এই বাসার ঠিকানা ধরে এসে গত কয়েক সপ্তাহে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। শুনেছি, একজন রিকশাচালকের হত্যার ঘটনায় হয়রানি করতে কয়েকশো মানুষের নামে সে মামলা করেছে। ভুল ঠিকানা দিয়ে তো এখন আমাদেরও হয়রানি করা হচ্ছে।"
পরিবারের সদস্য বা স্বজন না হয়েও আরেকজনের হয়ে হত্যামামলা করে হয়রানি-চাঁদাবাজির বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার তালেবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "হত্যামামলা একবার হওয়ার পর তো দ্বিতীয়বার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনিতেও এসব মামলায় চাঁদাবাজি-হয়রানি বন্ধে নির্দেশনা দেওয়া আছে। ভুয়া মামলা করে হয়রানি বন্ধে বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও ডিএমপি থেকে বলা আছে।"
এদিকে, মামলার বাদী কে এম শাহরিয়ার শুভ, তার ভাই কে এম নাজমুল ইসলাম ও তাদের আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ— তিনজনের সাথে যোগাযোগ করা হলে কেউই মামলার বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।