এনবিএফআইগুলোর গড় খেলাপি ঋণ ৩৫ শতাংশ, ৭ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৯০ শতাংশের বেশি
খেলাপি ঋণের বোঝায় জর্জরিত বেশিরভাগ ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের এনবিএফআইগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৩৫.৫২ শতাংশ। এর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ প্রায় ৯০–৯৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪-এর সেপ্টেম্বর শেষে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণই ৫০ শতাংশের বেশি।
২০২৪-এর জুন শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, অধিকাংশ এনবিএফআইয়েরই কার্যত কার্যক্রম নেই। এর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠান মৃতপ্রায়। বাকি যেসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশের বেশি, সেগুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।
অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং নিয়ম লঙ্ঘন করে এবং জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ বিতরণ করেছে। একাধিক প্রতিষ্ঠানের এসব অনিয়মের চিত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
আইআইডিএফসি-র ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, 'আগে অনেক প্রতিষ্ঠান খেলাপি ছিল, যা দেখানো হয়নি। কোভিডকালে পুনঃতফসিল সুবিধাসহ অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এখন ওইসব ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।'
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ-এর সাবেক চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খারাপ অবস্থা তৈরি করেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ। পর্ষদ পরিচালকরা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নামে-বেনামে ঋণ দিয়েছে। এছাড়া তাদের সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণসুবিধা দিয়েছে, যেগুলো ঋণ পাওয়ার যোগ্য না।
তথ্য অনুযায়ী, ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৭টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্স, ডিবিএইচ ফাইন্যান্স, আইডিএলসি ফাইন্যান্স, আইপিডিসি ফাইন্যান্স, লংকা বাংলা, স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স ও উত্তরা ফাইন্যান্স।
এদিকে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থিতিও কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুনে ঋণ ছিল ৭৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে তা কমে হয়েছে ৭৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকা।
৭ এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণ ৯০ শতাংশের বেশি
যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি, সেগুলো হলো: আভিভা ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং ও ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।
এর মধ্যে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স ও আভিভা ফাইন্যান্সের নানা জালিয়াতির অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন প্রশান্ত কুমার হালদার, ওরফে পি কে হালদার।
এফএএস ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণের হার ৯৯.৯২ শতাংশ বা ১ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অর্থ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে ৫২৩ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে। দক বলছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে তারা নিশ্চিত হয়েছে, অস্তিত্বহীন ১৩টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে এফএএস ফাইন্যান্স থেকে ৫২৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ১৩টি মামলা দায়ের করেছে দুদক। দুদকের মামলার তথ্য বলছে, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট থেকে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান শেষে প্রাথমিকভাবে ৫২৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক ১৩টি মামলা করা হয়েছে। মামলার তথ্যে বলা হয়, ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ বের করে নেওয়া হয়েছে।
ঋণ খেলাপিতে শীর্ষে থাকা আরেক প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ফাইন্যান্স। এ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৮৭২ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯৮ শতাংশ।
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট স্টকস অ্যান্ড বন্ড লিমিটেডের (এফএসবিএল) মাধ্যমে ৩১টি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণ দেখিয়ে ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করা হয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ-এর সাবেক চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, 'মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হলে তাকে বন্ধ হতে দেওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে গ্রাহকের আমানতের বিমা কাভারেজ খুবই সীমিত।
'আমি মনে করি যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া উচিত, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এছাড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একত্রে মার্জ করে দেওয়া যেতে পারে।'
মমিনুল ইসলাম পরামর্শ দেন, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে তাদের ছোট গ্রাহকের সম্পূর্ণ আমানত ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। এছাড়া যাদের বড় অঙ্কের আমানত রয়েছে, তাদের আংশিক পরিমাণে ফেরত দেওয়া উচিত। এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পদের মান যাচাই করে কয়েকটিকে একত্রে একীভূত করা যেতে পারে।
একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি পি কে হালদারের মাধ্যমেই বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যেসব অনিয়ম হয়ে গেছে, তার জের পুরো খাতকেই টানতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, পি কে হালদারের যে-কয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে ছিল, সেবব প্রতিষ্ঠানেরই খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। আবার এতদিন যেসব খেলাপি ঋণ গোপন করা হয়েছে, তা বেরিয়ে আসছে।
ওই উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, আগে পুনঃতফসিল সুবিধা নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করায় নতুন করেও এসব ঋণ খেলাপি হয়েছে। এছাড়া ৫ আগস্টের পর অনেক ব্যবসায়ী পলাতক রয়েছেন; তাদের ঋণও এখন খেলাপি হচ্ছে।
গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া বলেন, সরকারের বিল ও বন্ডের সুদহার বৃদ্ধির কারণে গ্রাহকরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ কম করছে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন আমানত পাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, 'দেশের যে অথনৈতিক পরিস্থিতি, এতে ব্যবসা-বাণিজ্যও সেভাবে হচ্ছে না। আবার ঋণের সুদহার বেশি হওয়াতে কেউ নতুন বিনিয়োগেও যাচ্ছে না।'