‘প্রোপাগান্ডা’ সেলের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েও হাসিনা সরকারের সাথে দূরত্ব রাখার দাবি টিউলিপের: টাইমস
যুক্তরাজ্যের সিটি মিনিস্টার ও দুর্নীতি বিরোধী মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক তার খালা শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের সময়কার 'প্রোপাগান্ডা' সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন-এর (সিআরআই) আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
টিউলিপ সিদ্দিক এখন আরও বেশি নজরদারির মুখে আছেন, কারণ তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়। শেখ হাসিনাকে ২০২৪ সালের আগস্টে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভিন্নমত দমন এবং গণমাধ্যমের ওপর সহিংস নিপীড়নের অভিযোগে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়।
ঢাকায় তদন্তকারীরা শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের আর্থিক লেনদেনের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। এই তদন্তে টিউলিপ সিদ্দিকের আর্থিক লেনদেনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) যুক্তরাজ্যের একটি স্বাধীন তদন্তকারী কর্তৃপক্ষকে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া একাধিক ফ্ল্যাটে বসবাস করেছেন। এমন অভিযোগ আসার পরেই তিনি এই তদন্তের অনুরোধ জানান।
টিউলিপ বারবার দাবি করেছেন, তার দেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব খাটানোর ইচ্ছা বা সামর্থ্য নেই। তিনি তার খালার সরকারের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছেন।
তবে, দ্য টাইমস-এর পাওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ২০১৫ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাস পরই তিনি সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন-এর (সিআরআই) আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন। এই সংস্থা শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। গত বছর ভুল তথ্য প্রচারের অভিযোগে ফেসবুক সিআরআইকে নিষিদ্ধ করেছিল।
ওই বক্তৃতায় টিউলিপ তার খালার নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশের নির্বাচনে বেশি ভোটার উপস্থিতির প্রশংসা করেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ভোট জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত।
বাংলাদেশি সাংবাদিক তাসনিম খলিল বলেন, "সিআরআই-এর মতো একটি সংস্থার আয়োজিত আলোচনায় টিউলিপ সিদ্দিকের বক্তৃতা দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না।" তিনি আরও বলেন, "সিআরআই প্রথমে হাসিনার বিরোধী দলে থাকার সময় গঠিত হয়। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর আরও আগ্রাসী ভূমিকা নেয়। এটি ভুয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিরোধী রাজনীতিকদের আক্রমণ এবং ভুয়া খবর প্রচার করেছে।"
তিনি আরও যোগ করেন, "ওই সময় সিআরআই-এর কার্যক্রম বিবেচনায়, একজন ব্রিটিশ এমপির জন্য তাদের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়া যথেষ্ট অদূরদর্শী ছিল।"
টিউলিপ সিদ্দিকের বোন আজমিনা এবং ভাই রেদওয়ান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-এর ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রেদওয়ান এই সংস্থার নিউজলেটার হোয়াইটবোর্ড-এর সম্পাদনার দায়িত্বেও ছিলেন।
ফেসবুকের মালিক মেটা গত বছর প্রকাশিত একটি "অ্যাডভারসারিয়াল থ্রেট রিপোর্ট"-এ সিআরআই-কে ভুয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট পরিচালনার মাধ্যমে খবর এবং ঘটনাবলি, বিশেষ করে নির্বাচন ও বিরোধী রাজনীতিকদের দুর্নীতির অভিযোগ প্রচারের জন্য অভিযুক্ত করেছে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আয়োজিত "লেট'স টক উইথ টিউলিপ সিদ্দিক" শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে টিউলিপ তার খালার "সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা ও ন্যায্যতার" মূল্যবোধ তাকে লেবার পার্টিতে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছে বলে মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, "আমার মা, খালা এবং নানা সবসময় বলতেন, আমরা সবার আগে জনগণের সেবক। আমরা এখানে মানুষের সেবা করার জন্য এসেছি। যা কিছু শিখেছি, তাদের থেকেই শিখেছি। সেই কারণেই আমি লেবার পার্টিতে যোগ দিয়েছি।"
দ্য টাইমস জানায়, টিউলিপ এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন ব্যক্তিগত খরচে এক সফরের সময়।
টিউলিপের মা ও খালা ১৯৭৫ সালে তাদের বাবা শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা হত্যা করার পর দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এমপি হওয়ার আগে টিউলিপ আওয়ামী লীগের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানাতেন। তিনি ২০০৯ সালে তার খালার নির্বাচনী জয়কে "গণতন্ত্র ও সহনশীলতার জয়" বলে অভিহিত করেন।
২০১০ সালের মে মাসে ক্যামডেনের প্রথম বাংলাদেশি কাউন্সিলর হওয়ার এক বছর পর তিনি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৬৬তম সাধারণ পরিষদে তার মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
২০১৩ সালে মস্কোতে একটি পারমাণবিক প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে টিউলিপ সিদ্দিককে তার খালা শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের পাশে দেখা যায়। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন এখন এই চুক্তি নিয়ে টিউলিপ, তার মা শেখ রেহানা (৬৯), শেখ হাসিনা এবং আরও দুই আত্মীয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে।
২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর টিউলিপ তার বিজয় ভাষণে আওয়ামী লীগের সমর্থনকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যে আয়োজিত আওয়ামী লীগের সমাবেশেও বক্তব্য রাখেন।
তবে এরপর থেকে তিনি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন।
২০১৭ সালে তার খালার শাসনামলে আটক একজন ব্রিটিশ-বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি কর্মীকে সহায়তা না করার অভিযোগে সমালোচিত হওয়ার পর টিউলিপ সিদ্দিক চ্যানেল ৪-কে বলেছিলেন, "আমি একজন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য। সাবধান থাকুন। আমি বাংলাদেশি নই এবং আপনি যার কথা বলছেন, তার মামলা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।"
পরে তিনি বলেন, "বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার আমার কোনো ক্ষমতা বা ইচ্ছা নেই।"
তবে শেখ হাসিনার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিরোধীদের একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে এখন টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের তদন্তের মুখে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) টিউলিপ, তার বোন, ভাই, মা এবং খালার আর্থিক বিবরণী সংগ্রহের ঘোষণা দেয়।
এছাড়া, শাসকগোষ্ঠীর মিত্রদের সঙ্গে তার আর্থিক সংযোগ নিয়ে ওঠা প্রশ্নের প্রেক্ষিতে টিউলিপ নিজেই প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের নীতিগত পরামর্শদাতা লাউরি ম্যাগনাসের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের লন্ডনের কেন্দ্রস্থল কিংস ক্রসে ৭ লাখ পাউন্ড মূল্যের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যা তাকে তার খালার একজন রাজনৈতিক মিত্র উপহার দিয়েছেন। তিনি ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড মূল্যের আরও একটি ফ্ল্যাটে থেকেছেন, যা তার বোন আজমিনা (৩৪) তার খালার এক উপদেষ্টার কাছ থেকে পেয়েছেন।
উত্তর লন্ডনে তাদের মায়ের বসবাস করা ১.৪ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের পারিবারিক বাড়িটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর একজন কর্মকর্তার মালিকানাধীন। ওই কর্মকর্তার বাবা শেখ হাসিনার সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখার জামান বলেন, "শেখ হাসিনার শাসন ছিল সবচেয়ে খারাপ ধরনের এক লুটেরা শাসন, যা তার পরিবার এবং সমর্থকদের সম্পদশালী করার জন্য তৈরি হয়েছিল।" তিনি আরও বলেন, টিউলিপের "নিজেকে স্বচ্ছ রাখতে এবং স্বার্থের সংঘাত এড়াতে তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য পদত্যাগ করা উচিত।"
টিউলিপের একজন মুখপাত্র বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থনের সঙ্গে এসব সম্পত্তির কোনো সম্পর্ক রয়েছে বলে করা দাবি "সম্পূর্ণ ভুল।"
ব্রিটিশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, টিউলিপ তার অর্থনৈতিক অপরাধ বিষয়ক দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন না। তিনি যে কোনো ধরনের অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বিএফআইইউ-এর অভিযোগের বিষয়ে টিউলিপের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তার মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, "এই অভিযোগের জন্য কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।" তিনি আরও যোগ করেন, "টিউলিপের সাথে বিষয়ে কেউ যোগাযোগ করেনি এবং তিনি এই দাবি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন।"