ইরান সিরিয়ায় ‘বাজেভাবে হেরেছে’, এক শীর্ষ জেনারেলের স্বীকারোক্তি
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিবাদমান বিভিন্ন পক্ষকে সমর্থন দিয়েছিল আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন শক্তি। এরমধ্যে ইরান ও রাশিয়া বাশার আল-আসাদ সরকারের পক্ষ নিয়েছিল। কিন্তু আসাদ শাসকগোষ্ঠীর পতনের ফলে তেহরানের কঠোর পরাজয় হয়েছে। এমন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ইরানের শীর্ষ এক সেনাধ্যক্ষ।
গত সপ্তাহে রাজধানী তেহরানের এক মসজিদে বক্তব্য দেওয়ার সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বেহরৌজ এসবাতি একথা বলেন। তাঁর ওই বক্তব্যের একটি অডিও রেকর্ড সম্প্রতি জনসমক্ষে এসেছে। সেখানে তাঁকে বলতে শোনা যায়, "সিরিয়ায় পরাজয় গর্ব করবার কোনো বিষয় নয়। ... আমাদের পরাজিত করা হয়েছে, আর সে পরাজয় হয়েছে খুবই বাজেভাবে। আমাদের ওপর চরম আঘাত এসেছে, যা (কাটিয়ে ওঠা) খুবই কঠিন।"
গত সোমবার জেনারেল বেহরৌজ এসবাতির ওই অডিও রেকর্ড প্রকাশ করে জেনেভা-ভিত্তিক নিউজ সাইট **আবদি মিডিয়া**। গণমাধ্যমটি প্রবাসে ইরান-কেন্দ্রিক সংবাদ প্রচার করে থাকে। এর আগে ইরানের স্থানীয় গণমাধ্যমেও প্রচার হয় ধারণকৃত বক্তব্যটি।
এই প্রথম জেনারেল এসবাতির মতো শীর্ষ কোনো কর্মকর্তা— সিরিয়ার প্রসঙ্গে দেশটির আনুষ্ঠানিক বিবৃতিগুলোর বাইরে গিয়ে মন্তব্য করলেন। আসাদের পতনের পর থেকে ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা যেমনটা বলে আসছেন, এটি তার বিপরীত। তবে সিরিয়ায় ইরান তার কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা চালাবে বলে তিনি জানান।
এর আগে ইরানের প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য শীর্ষ নেতারা সিরিয়ায় পরাজয়কে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁরা এই পরাজয়কে মামুলি আঘাত হিসেবে উপস্থাপন করে আসছিলেন।
এ বিষয়ে জেনারেল এসবাতি অবশ্য স্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। তিনি জানান, পতনের আগে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে বাশার আল-আসাদের সাথে ইরানের টানাপোড়েন চলছিল। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর সিরিয়া থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আরেকটি ফ্রন্ট চালু করতে চেয়েছিল তেহরান। এ বিষয়ে বাশারকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তিনি সেগুলো নাকচ করে দেন।
তেহরান মনে করেছিল, ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনুমতি দেবেন বাশার। এজন্য তাঁকে বিস্তারিত সামরিক পরিকল্পনা সম্পর্কে জানানো হয়। পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়, সিরিয়ায় থাকা ইরানের সামরিক সরঞ্জাম ও জনবল দিয়ে কীভাবে এ ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করা সম্ভব। কিন্তু, তেহরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়েও তাতে সায় দেননি বাশার আল-আসাদ।
জেনারেল এসবাতি লজ্জাজনক এই পরাজয়ের জন্য রাশিয়াকেও দোষারোপ করেন। তিনি বলেন, "সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ওপর রুশ যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হচ্ছে"— রাশিয়া আমাদের এমন কথা বলেছিল। যদিও আসলে তারা বোমা ফেলছিল খোলা মাঠ-ময়দানে। গত বছর ইসরায়েল যখন সিরিয়ায় ইরানের সামরিক অবস্থানগুলোয় হামলা চালায়, তখন রুশ বাহিনী তাদের এয়ার ডিফেন্স রাডারগুলো বন্ধ করে রেখেছিল। এভাবে তেল আবিবকে এই আক্রমণ করার সুযোগ দেয় রাশিয়া।
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাশার আল-আসাদের সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ব্যাপক সংখ্যায় সেনা ও রসদ পাঠিয়েছে ইরান। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আসাদ বাহিনীকে দিক-নির্দেশনা দিতেও দেশটিতে অবস্থান করেছেন শীর্ষ ইরানি কমান্ডাররা। তবে ইরান ইসলামিক স্টেট-খ্যাত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়েও ভূমিকা রেখেছে।
আসাদের সময় সিরিয়া ছিল ইরানের একটি আঞ্চলিক কমান্ড সেন্টার, যেখান থেকে অর্থ ও অস্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে পাঠানো হতো। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল— লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা। সিরিয়ায় বিভিন্ন বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করতো ইরান। ছিল মিসাইল ও ড্রোন ঘাঁটিসহ অস্ত্রশস্ত্রের বিপুল মজুত।
এতকিছুর পরেও গত ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীদের ঝটিকা আক্রমণের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদ। একের পর এক শহরের দ্রুত পতন এবং বিদ্রোহী জোটের দ্রুত অগ্রসর হওয়া তেহরানকেও হতচকিত করে। কিন্তু পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পায়নি ইরান। যুদ্ধের ময়দানে বিদ্রোহীদের অগ্রগতি বিস্ময়করভাবে দ্রুত হয়েছে।
সিরিয়ায় বর্তমানে বিদ্রোহীরা একটি সরকার গঠন করেছে। জেনারেল এসবাতি এটাও বলেছেন যে, নতুন সিরিয়া যেদিকেই যাক না কেন— ইরান এই সরকারের বিরোধীদের নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করবে।
তিনি বলেন, "বহু বছর ধরে আমরা যেসব নেটওয়ার্কের সঙ্গে কাজ করেছি— এখন তার সবগুলোকে সক্রিয় করতে পারি। সিরীয় সমাজের যেসব স্তরে আমাদের লোকেরা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেছে— সেগুলোকে কাজে লাগানো যাবে। আমরা সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় হতে পারি বা প্রতিরোধের সেল গড়ে তুলতে পারি।"
"আন্তর্জাতিক অন্যান্য অঙ্গনে আমরা যেভাবে কাজ করে আসছি, এখন সেখানেও (সিরিয়ায়) একইভাবে কার্যক্রম চালাতে পারি। ইতোমধ্যেই সেসব কাজ আমরা শুরু করেছি," তিনি যোগ করেন।