সামষ্টিক অর্থনীতির চার মৌলিক সত্য
সম্প্রতি আমাকে এক ক্লাব হাউজে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো ম্যাক্রো বা সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করতে। সেখানে, বহু শ্রোতাকেই দেখেছি আমার বক্তব্যের বিষয়টির প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সাফাই গাইতে সেজন্য বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যাসহ আরও কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি।
সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ে জানার প্রথম এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চাহিদার তীব্র নেতিবাচক ধাক্কা বা নেগেটিভ শক। অনাকাঙ্খিত ভাবে চাহিদা হ্রাস পেলে সাধারণত তার প্রভাব উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের উপর গিয়ে পড়ে। জটিল সমাজতাত্ত্বিক কারণে ন্যূনতম মজুরির পরিমাণ প্রায় একই থাকে। আর তাই নিয়োগকর্তারা চাহিদা কমলেই কর্মীদের বেতন কমাতে পারেন না। পরিবর্তে তারা কর্মী ছাঁটাই করেন। ফলস্বরূপ, তা ডেকে আনতে পারে অর্থনৈতিক মন্দা।
শুনতে খুব সহজ এক বিষয় মনে হতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হল এই তত্ত্ব। গ্রেট ডিপ্রেশন থেকে শুরু করে ৭০ এবং ৮০'র দশকে মুদ্রাস্ফীতির অবসান এবং ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের সময় এই তত্ত্ব সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল, একটি সুব্যবস্থাপনা সম্পন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদার এই ধাক্কাকে যথেষ্ট মাত্রায় সামাল দিতে পারে। এমনকি, প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যার উত্থানকেও রুখে দিতে পারে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মিশ্র অর্থনৈতিক লেনদেন কিংবা ন্যূনতম চাহিদাকে স্বাভাবিক রাখতে বেশি করে টাকা ছাপানোর মাধ্যমে ব্যাংক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
তৃতীয় বিষয়টি হল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি পাগলের মতো টাকা ছাপাতে শুরু করে তাহলে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। তবে এখানে একটি ব্যতিক্রমের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০০৮ এবং ২০০৯ সালের দিকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক রিজার্ভের সুদ পরিশোধ করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি একই সাথে অর্থের গতিবেগ বা ভেলোসিটি অব মানি কমাতে পারে অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার লেনদেন কমাতে পদক্ষেপ নিতে পারে- তাহলে মুদ্রাস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে।
চতুর্থ বিষয়টি হল নন-মনেটারি বা আর্থিক খাত বহির্ভূত ধাক্কা। বড় ধরনের ধাক্কা মন্দা কিংবা অতিমন্দার সৃষ্টি করতে পারে। ১৯৭৩ সালের তেলের মূল্য সংক্রান্ত বিপর্যয়ের কথাই ধরা যাক। কিংবা বর্তমান সময়ের মহামারি বা অতীতে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় খারাপ ফলনও, এর উদাহরণ হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আংশিকভাবে এই ধাক্কা সামলাতে পারলেও পুরোপুরি থামাতে পারে না।
আমার ধারণা অধিকাংশ সামষ্টিক অর্থনীতিবিদ বিষয়গুলোর সাথে একমত হবেন। তবে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর তারা অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে পারেন। সামষ্টিক অর্থনীতিকে গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে এই চারটি বিষয়ই যথেষ্ট।
তবে বেশ কিছু পরিসংখ্যান থাকা সত্ত্বেও জলঘোলা হতে পারে।
এখন ভাবুন, একটি উন্নত অর্থনীতি কত বড় বাজেট ঘাটতি কোনো অর্থনৈতিক সংকট ছাড়াই সামাল দিতে সক্ষম? আসলে কেউই এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানেন না। তবে, কাগজে-কলমে আছে যে উচ্চ-রিটার্ন সম্পন্ন জনবিনিয়োগের মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা জোরদার করা সম্ভব। এ ধরনের বিনিয়োগ থেকে রাজস্ব ছাড়াও অন্যান্য সুবিধা লাভ করা যেতে পারে। অন্তত একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হলেও। বাজারও সাধারণত আগে থেকেই এই লাভের আন্দাজ করতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা যদি অর্থনৈতিক নীতিটির বিষয়ে একমত না হন তবে তা জনবিনিয়োগ থেকে প্রাপ্যতা লাভের বিষয়ে। (যারা বাম ঘেঁষা আছেন তারা সাধারণত জনবিনিয়োগ থেকে উচ্চলাভে বিশ্বাস করে থাকেন, অন্যদিকে ডানপন্থীরা মনে করেন সরকার সঠিক খাতে বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হবে।) বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তব বিতর্ক হলেও বিষয়টি আসলে অর্থনীতির পলিসি এবং সরকারের অবস্থার উপর নির্ভর করে। এটি সামষ্টিক অর্থনীতির বিতর্কের বিষয় নয়। সামষ্টিক ধারণায় বিশ্লেষণ সবসময় একই থাকে।
এখন আপনি চারটি বিষয় এবং এই বিতর্ক বুঝে গেলে, আমি সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে আমার শঙ্কার কথা বলছি। আমি জানি না মূল্যবৃদ্ধি ১.৭ শতাংশ হওয়া উচিত নাকি ২ শতাংশ। এধরনের আলোচনাও আমার কাছে দুর্বোধ্য লাগে। স্ফীতির হার ২ শতাংশ হোক বা ২.২ শতাংশ, আমার জন্য সবই ঠিক আছে।
আমার মনে হয় না সামষ্টিক অর্থনীতিবিদরা ভালোভাবে বিনিয়োগ নিয়ে হিসাব-নিকাশ করতে পারে। বিশেষ করে প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের করপোরেট অ্যাসেটগুলো, যা অপরিমেয় হয়ে থাকে। কিংবা, যুক্তরাষ্ট্রে 'বিনিয়োগ খরা' চলছে কি না, সে প্রশ্নের উত্তরও আমরা দিতে পারব না। এমনকি আমরা সামষ্টিক অর্থনীতির তিনটি বড় ক্ষেত্র- বিনিয়োগ হার, প্রকৃত সুদের হার কিংবা সামগ্রিক স্টকমূল্য সম্পর্কে ঠিকমতো পুর্বাভাসও করতে পারব না। আমার মনে হয়, আপনি এ বিষয়ে বিতর্কের সবগুলো পক্ষের বক্তব্য শুনেই কিছু না কিছু শিখতে পারবেন। তবে, দিন শেষে অজ্ঞেয়বাদী থাকাটাই ভালো। আমার কাছে এটাও মনে হয় যে, দীর্ঘকালীন মেয়াদে মূল্যস্ফীতির পরিমাপ একদম ফালতু একটি বিষয়। কেননা, ১৯৫০ সালের তুলনায় বর্তমান সময়ের মানুষের চাহিদা এবং ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রীর ফারাক অনেক।
পরিশেষে, আমাকে আরেকটি তথ্য যোগ করতে দিন। সত্যি হলেও বিষয়টি নিশ্চিত বা সর্বজনগৃহীত নয়। জনসংখ্যার বৃদ্ধি সাধারণত অর্থনীতির জন্য ভালো। তেমনি, অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত থাকলে, জনসংখ্যার হ্রাস অর্থনীতির জন্য খারাপ একটি বিষয়।
অবসরে সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে ঠাট্টা করা মানুষের বহু পুরোনো অভ্যাস। এটা সত্যি যে, আমরা অনেক কিছু জানি না বা বুঝি না। তবে, সামষ্টিক অর্থনীতির সাথে থাকার থেকেও একটাই খারাপ দিক হতে পারে (কিংবা, সামষ্টিক অর্থনীতিবিদের সাথে থাকা, আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে পারেন), তা হলো সামষ্টিক অর্থনীতিই না থাকা।
- লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ও ব্লুমবার্গের নিয়মিত কলাম লেখক। তার একটি বহুল পঠিত গ্রন্থ "বিগ বিজনেস: এ লাভ লেটার টু অ্যান আমেরিকান অ্যান্টি-হিরো।"
- অনুবাদ: তামারা তমা