প্যান্ডোরা পেপারস: যেভাবে ক্ষমতাবানরা জনসাধারণের দৃষ্টি থেকে সম্পদ লুকিয়ে রাখেন
বিশ্বজুড়ে ছয়শর বেশি সাংবাদিকের তদন্তে উঠে এসেছে, অফশোর ব্যাংকিং-এর ফাঁকি। কীভাবে ছায়াময় এই ব্যাংকিং সিস্টেম ব্যবহার করে অভিজাতরা নিজেদের টাকা লুকিয়ে রাখছেন তা প্রকাশ পেয়েছে "প্যান্ডোরা পেপারস" নামের এক নথিতে।
বিবিসি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অফশোর কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগকারী হিসেবে বিভিন্ন দেশের সাবেক ও বর্তমান অন্তত ৩৫ জন নেতার নাম পাওয়া গেছে। এছাড়াও পাওয়া গেছে ৩০০-র বেশি সরকারি কর্মকর্তার নাম।
রাজনীতি ও ধনকুবেরদের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য সংবলিত এই গোপন নথি প্রকাশের মধ্য দিয়ে আবারও একটা বড় ধাক্কা লাগল গোটা বিশ্বে।
প্যান্ডোরা পেপারস ইতোমধ্যেই পেয়েছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার খেতাব।
ট্যাক্স হ্যাভেন বৈধ, তবে সেগুলো অবৈধ (বা অপ্রীতিকর) উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
লেখকদের মতে, "অফশোর ব্যাংকিং" মূলত দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যে ব্যবস্থায় মানুষ তাদের সম্পদ গোপন রাখতে পারে। তবে এখন এটি ব্যক্তির নিজ দেশের বাইরে এমন জায়গাকে বোঝায় যেখানে প্রচলিত নিয়ম না মেনেই তারা তাদের অর্থ লুকিয়ে রাখতে পারে। ফলে এই লুকিয়ে রাখা অর্থের জন্য তাদের কোথাও জবাবদিহিতা করতে হয়না, দিতে হয়না কোনো ট্যাক্স।
প্যান্ডোরা পেপারে প্রকাশিত আর্থিক পরিষেবা সংস্থাগুলো মূলত বেলিজ, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস, সুইজারল্যান্ড এবং সেইসঙ্গে দক্ষিণ ডেকোটা এবং ডেলাওয়্যার সহ মার্কিন রাজ্যে ব্যবসা করে থাকে।
তবে, অফশোর ব্যাংকিং অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অবৈধ নয়। সাংবাদিকরা যতগুলো সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছে, সবাই জানিয়েছে তাদের সংস্থা আইন অমান্য করে কোনো কাজ করেনি। তবে, গ্রাহকরা এই ব্যবস্থাকে অবৈধ কাজে ব্যবহার করতে পারে। এর মাধ্যমে সম্পদ লুকিয়ে রেখে তারা সরকারকে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারে খুব সহজেই।
কেলেঙ্কারির সঙ্গে বিশ্ব নেতাদের অনেকেই জড়িত
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক খবরে বলা হয়, রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়া সত্ত্বেও, জর্ডানের শাসনকর্তা বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে বিলাসবহুল সম্পত্তির জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বহু বছর ধরে সম্পর্ক রয়েছে বলে সন্দেহ করা এক নারী মালিক হয়েছেন দামি মোনাকো অ্যাপার্টমেন্টের। শোনা যায়, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সন্তান জন্ম দেওয়ার কয়েকদিন পরেই অ্যাপার্টমেন্টটি তিনি উপহার হিসেবে পান।
প্যান্ডোরা পেপারসে প্রকাশিত তিনশ'রও বেশি বর্তমান ও সাবেক রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই দুইজন ছিলেন বলে জানিয়েছেন সাংবাদিকরা।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির পরেও অফশোর ব্যাংকিং একটি লাভজনক শিল্প হিসেবেই রয়ে গেছে
পাঁচ বছর আগে যখন "পানামা পেপারস" কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়েছিল, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, সেই ঘটনা অফশোর ব্যাংকিংয়ে বড় ধরণের সংস্কার আনবে। মানুষের পক্ষে তাদের সম্পদ গোপন করে রাখা কঠিন করে তুলবে।
কিন্তু প্যান্ডোরা পেপারস কেলেঙ্কারি তাদের সেই ধারণাকে ভুলই প্রমাণিত করল।
ফাঁস হওয়া নথিতে, উনত্রিশ হাজারেরও বেশি অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ পাওয়া গেছে, যা ২০১৬ সালে ফাঁস হওয়া পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির অ্যাকাউন্ট সংখ্যার তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
সাউথ ডেকোটা একটি অফশোর ট্যাক্স হেভেন!
প্যান্ডোরা পেপারসের আরও একটি বিস্ময়কর ফলাফল হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও অফশোর ব্যাংকিং বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। সাংবাদিকরা বলছেন, "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত সাউথ ডেকোটা এবং নেভাদা "আর্থিক গোপনীয়তা আইন গ্রহণ করেছে।"
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিদেশী নেতারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা ব্যক্তিগত সম্পদ জমা করার জন্য মার্কিন ভিত্তিক ট্রাস্ট ব্যবহার করেছেন।
তবে এখনও, বিশ্বের অনেক ধনী নাগরিক, যেমন অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস এবং টেসলার এলন মাস্কের নাম প্যান্ডোরা পেপারসে আসেনি।
সাংবাদিকরা বলছেন, বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তাদের নাম প্যান্ডোরায় উঠে আসেনি কারণ তারা হয়তো এমন অফশোর ব্যাংকিং সংস্থা ব্যবহার করে থাকেন যেগুলো প্যান্ডোরা পেপারসের অন্তর্ভুক্ত নয়; অথবা এমনও হতে পারে, অতি ধনী ব্যক্তিদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করের হার এত কম যে, তাদের সম্পদ আড়ালের কোনো প্রয়োজনই পড়ে না।
সূত্রঃ এনপিআর