ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকে কি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যাগুলোর সমাধান মিলবে?
গত ৭ অক্টোবর ছিল আবরারের মৃত্যুদিন। ২০১৯ সালের এইদিনে কেঁপে উঠেছিল গোটা দেশ; যেন এক ভূমিকম্প! বুয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ২১ বছর বয়সী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে এবং রাতভর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। আবরারের অপরাধ সে 'সিনিয়র ভাইদের' মন রক্ষা করে চলতে পারেনি।
আমরা ইতিহাসের পাতায় কিংবা বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে অত্যাচারী জমিদারের যে নিষ্ঠুরতার চিত্র পাই এটা তার চেয়েও ভয়াবহ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল সম্পর্কিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এটি। দেশের সর্বোচ্চ মেধারীরা এখানে পড়ার সুযোগ পান। তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাইয়ের ভিত্তিতে ভর্তির তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। তাহলে এরকম পড়ুয়া-মেধাবীদের মধ্যে এই হিংস্রতার প্রবেশ ঘটল কীভাবে? এই বর্বরতা তারা কোথা থেকে শিখলো? আবরারের মৃত্যু হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। সারারাত ধরে নানাবিধ অত্যাচারের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের মামলা বিচারাধীন এবং নিষ্পত্তির দ্বারপ্রান্তে।
বিচারিক আদালতে রায়, উচ্চ আদালত ও আপিলসহ সব মিলিয়ে সামনে আছে দীর্ঘপথ। বলা হয়, আইনের হাত যেমন লম্বা তেমন আইনের পথও দীর্ঘ। আইন তার নিজস্ব গতি ও নিজস্ব পথে চলুক। আমরা মনোযোগ দিতে চাই এই জাতীয় ঘটনার পিছনের মনস্তত্ত্ব ও সংস্কৃতির দিকে। এই অনুসন্ধানটি খুব গভীর ও নিবিড় হওয়া জরুরি।
আমাদের দেশ থেকে মেধা পাচার আগেও ছিল। কিন্তু এখন তার ব্যাপকতা বেড়েছে বহুগুণ। মেধার অপচয় কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। এই হত্যাকাণ্ডের শিকার আবরার ও অভিযোগপত্রে নাম আসা প্রায় সকলের বয়স কাছাকাছি। দুই-তিন বছরের কমবেশি। আমরা অনেকেই এই বয়সী সন্তানের পিতা বা অভিভাবক। বাবা-মা কত কষ্ট করে, যত্ন করে, নিজেদের সকল সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে এই সন্তানদের বড় করেন তা আমরা জানি। বুয়েটে ভর্তি হতে পারাটা আশীর্বাদ মনে করেন সকলে। বাবা-মা যেন একটু নিশ্চিন্ত জীবনে ফিরে যান। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে থাকেন।
খুব কড়া শাসনে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সিনিয়র-জুনিয়র এর নানা গল্প আমরা শুনেছি। সিনিয়ররা জুনিয়রদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে সদা ব্যস্ত থাকে। অনেক নামী-দামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এরকম দেখা যায়। ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও চিত্ৰনাট্যকার চেতন ভগত তার লেখা বেস্টসেলার বই "ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান" অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র "থ্রি ইডিয়টস" এর মধ্যে আমরা এই প্রবণতা দেখেছি। নতুনদের কীভাবে প্রতি পদে পদে হেনস্তা করা হয় তার চিত্র চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ। ভয়ানক এই র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে বহু শিক্ষার্থীর নীরব প্রস্থান ঘটেছে বুয়েট থেকেই।
যদিও বিষয়টি কেবল আমাদের দেশের সমস্যা, এমনটি নয়। বাবা-মার শাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠা সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবাদের মধ্যে কর্তৃত্বপরায়ন হওয়ার ঝোঁক থাকাটা স্বাভাবিক। পাড়ার বিভিন্ন খেলার টিম গঠন থেকে শুরু করে বন্ধুদের ছোটখাটো আড্ডাতেও নানাবিধ গল্প বা দুঃসাহসিক কিছু করার মাধ্যমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা সহজাত। চেষ্টা থাকে আড্ডার মধ্যমনি হওয়ার। এই 'কিছু একটা করে দেখানোর প্রবণতা' তাকে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা।
আবরারের মৃত্যু উটপাখির মত মুখ লুকিয়ে চলা সভ্যতার মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। ইদানীং পাড়া মহল্লায় গজিয়ে ওঠা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে বুয়েটের ওই ছাত্রনেতাদের কোনো তফাৎ নেই। লক্ষ্যহীন, আদর্শহীন, নীতি-নৈতিকতাহীন এক অদ্ভুত প্রজন্ম এরা। এই সীমাহীন কর্তৃত্ববাদের উৎস কোথায়? এরা শুধু হলের সিট বণ্টন করে তা নয়। কে কোন পোশাক পরবে, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে বা কাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট (ফেসবুক) পাঠাবে তাও ঠিক করে দেন এসব কথিত বড় ভাইয়েরা। এমনকি ক্যাম্পাসের কে কোন পর্যন্ত যেতে পারবে বা ক্যান্টিনে কতক্ষণ বসতে পারবে তা আগে থেকে রফা করে নিতে হয়।
বাসে যাতায়াতের ক্ষেত্রেও তাই। সিট খালি থাকলেও আগাম অনুমতি নেওয়া না থাকলে আপনি বসতে পারবেন না। আবরার নিহত হওয়ার পর এসমস্ত বিষয় প্রকাশ পেতে থাকে। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, এতক্ষণ যাদের কথা বলা হলো, তারা সকলেই ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত। এরা সকলেই একটি বিশেষ ছাত্রসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। এই সকল নেতাদের আচরণের সাথে ছাত্ররাজনীতির চেনা ধরনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবরার হত্যামামলার সকল আসামী এই ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারা রয়েছেন এই মামলায়।
আবরার নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী মানুষের ক্ষোভ ও ধিক্কার ছাত্র সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিল। ফলে ঐ কমিটি বিলুপ্ত করে অভিযুক্ত সকলকে বহিষ্কার করতে কালবিলম্ব করেনি। পুলিশের তদন্তকাজে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু বুয়েটের শিক্ষার্থীরা যেকোনো ধরনের ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবিতে সংগঠিত হতে থাকে। অন্যান্য দাবির সাথে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়।
আবরারের প্রতি ভালোবাসা, আবেগ ও যুক্তি একাকার হয়ে শিক্ষার্থীদের ১০ দফার আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। একমাসের অধিক সময় ধরে চলা আন্দোলনে প্রশাসন নতিস্বীকারে বাধ্য হয় এবং শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়া হয়। এই ঘোষণার ফলে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক, অধিকারভিত্তিক ও ন্যায়সংগত দাবি নিয়ে সংগঠিত হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল সত্য; তবে ছাত্ররাজনীতির নামে যা চলছিল তা চিরতরে বন্ধ হওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন।
আবরার যখন নিহত হন তখনো করোনা থাবা বিস্তার করেনি। বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ঢেউ বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছড়ে পড়ে। বড় সংগঠনটিতে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা হয়। সাংগঠনিক শৃঙ্খলার বাইরে কেউ গেলে স্থায়ী বহিষ্কারাদেশের আওতায় আসতে হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। দৃশ্যমান কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতির গুণগত ও পরিমাণগত উন্নয়ন ঘটেনি।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সিলেটের এমসি কলেজে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে। জানা যায়, কলেজ ও হোস্টেল বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ওই বিশেষ ছাত্র সংগঠনের নেতারা হোস্টেলের দুটি কক্ষ জোর করে নিজেদের দখলে রাখে। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে ওই কক্ষে এবং জড়িত সকলে ওই ছাত্রসংগঠনের নেতা। তবে আশার কথা হলো, অপরাধী সকলকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
অপরাধীর কোনো দলীয় পরিচয় নেই, এমন কথা আমরা প্রায়ই শুনি। কেবলমাত্র পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়ন কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মাদক চোরাচালান ও অস্ত্র ব্যবসার মত ভয়ঙ্কর অপরাধের সাথে যুক্ত হওয়ার ছবিসহ প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশ্যে অস্ত্র উচিয়ে মহড়া দিতেও দেখা যায়। এখন দুই দলের মধ্যে সংঘাত হয় না। হয়, নিজ দলের দুই গ্রুপের মধ্যে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের 'পার্সেন্টেজের' হিস্যা নিয়ে বিবাদে জড়ানোর খবর প্রায় সকল গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় খবরের শিরোনামে অনেকদিন ধরে। দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতির হাজারো অভিযোগ মাথায় নিয়ে বিদায় নেওয়া উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। ভিসি মহোদয় শেষ কর্মদিবসে ১৩৮ জনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ প্রদান করে গেছেন যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত। শিক্ষামন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে জানিয়েছে, এই নিয়োগ অবৈধ ও এখতিয়ার বহির্ভূত। ১৩৮ জনের প্রায় সকলে একটি বিশেষ ছাত্রসংগঠনের প্রাক্তন নেতা। এই নিয়োগ মেনে না নিলে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার হুমকির মধ্যে রয়েছে বর্তমান প্রশাসন।
সমস্যাগুলো থেকে বের হওয়ার উপায় যে নেই তা কিন্তু নয়। বদ্ধ অবস্থা কোনো মঙ্গল বয়ে আনে না। '৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে ভূমিকা রেখেছে এদেশের ছাত্র সমাজ। আর ছাত্র রাজনীতি মানে শিক্ষার অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করা। ঢাকার রাজপথ বহুবার রঞ্জিত হয়েছে ছাত্রদের তাজা রক্তে। এরশাদের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহা'রা জীবন দিয়েছেন। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মিছিলে জীবন দিয়েছেন সেলিম, দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়াসহ অনেকে। গোটা ৮০ ও ৯০-এর দশক ছাত্রসমাজ স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহজাহান সিরাজ, রিমু রাজশাহী মেডিকেলের প্রতিভাবান ছাত্রনেতা ডা. জামিল আকতার জীবন দিয়েছেন। জেল, জুলুম, অত্যাচার ভোগ করার তালিকা আরো দীর্ঘ। যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের আন্দোলনে অগ্রভাগে থেকেছে এদেশের ছাত্র সমাজ।
মত প্রকাশ ও সংগঠিত হওয়ার অধিকারকে সবার আগে মুক্ত করে দিতে হবে। সর্বক্ষেত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত কারিকুলামের বাইরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং ছাত্রসংসদের নির্বাচন নিয়মিত করতে হবে। ছাত্র সংসদের নির্বাচন মানে আদালতের নির্দেশনা পূরণের নির্বাচন নয়। সে রকম নির্বাচনের পরিণতি আমরা দেখেছি।
জাতীয় রাজনীতির ময়দানে নিজের জায়গা করে নেওয়ার চিন্তা থেকে ছাত্ররাজনীতি দেখলে চলবে না। সাম্প্রতিক সময়ে আদালতের এক ঐতিহাসিক নির্দেশে নির্বাচিত ডাকসু ভিপিকে দেখেছি, ডাকসুর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে থেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে। এই জাতীয় তৎপরতা ছাত্র রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করবার সুস্থ প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত করা গেলে নেতাদের 'প্রভুত্ব' করার মানসিকতা দূর হবে। এরকম একটা মুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা গেলে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, সমাজেও ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হবে।