বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে জি-২০ জোটে প্রয়োজন ‘স্পুটনিক মুহূর্ত’
চলতি সপ্তাহান্তে (৩০-৩১ অক্টোবর) ইতালির রোমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জি-২০ জোটের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের বৈঠক। এবারের সম্মেলন বিশেষ একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য চারটি বৃহত্তর নীতিনির্ধারণী প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণে এ সম্মেলন এক সুবর্ণ সুযোগ। কারণ ঘুরে ফিরে এসব নীতির প্রভাবই বারবার তুলেছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
তাছাড়া, আরও শক্তিশালী ও স্থায়ী পুনরুদ্ধার সৃষ্টির পাশাপাশি, তা যেন টেকসই ও সুষম হয়- সেই চাবিকাঠিও জি-২০ নেতৃত্বের হাতে। এমনটা করা গেলে, আর্থিক বাজারের অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের কল্যাণ ব্যাহত করবে না। কিন্তু জি-২০ নেতৃত্ব সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনরুদ্ধার নিয়ে যত দেরী করবেন, সমাজের বৃহত্তর অংশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চক্র ততই শক্তিশালী হবে। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ভয়াল সংকট মোকাবিলা করাও মুখ থুবড়ে পড়বে।
গত ছয় মাস ধরে আমি পরামর্শ দিয়েছি, শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের এই মেয়াদকে যেন শীর্ষ অর্থনীতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ একটি সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে সতর্ক প্রণোদনামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে। ফেডারেল রিজার্ভ এখনও জরুরি হস্তক্ষেপের নীতিতে রয়েছে; কিন্তু তার সঙ্গে স্ফীত পুঁজিবাজারের কারণেই আরও বুঝেশুনে পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার।
অথচ ফেডারেল রিজার্ভ বা অন্য কোনো বৃহৎ অর্থনীতির ব্যাংক, কেউই এমনটা করার খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। বরং কোভিডজনিত অভিঘাত থেকে সহায়তা দানের প্রাথমিক উদ্দেশ্যকেই বার বার যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে। অথচ তারা আর্থিক বাজারের অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি, ক্রমে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির ভীষণ চাপকে 'সাময়িক' বা 'ব্যবস্থাপনা' যোগ্য বলে নগণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে।
কিন্তু অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্ত ও মূল্যস্ফীতির নেপথ্য চালিকাশক্তিগুলো তাদের সে যুক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে, পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরাও এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস ও পথপ্রদর্শক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকেও এবার দুটি নীতিনির্ধারণ বিষয়ক বাধ্যবাধকতার মুখে পড়তে হবে। অথচ আরও আগে এমনটা করলে তারা সমন্বয়ের জন্য দীর্ঘ সময় পেত।
প্রথম অত্যাবশ্যকীয় নীতিটি হলো, বাজারে তারল্য কমাতে বৃহৎ পরিসরে সম্পদ ক্রয় কমানো এবং সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করা। মূল্যস্ফীতির নেপথ্য কারণগুলোর বিন্যাস বুঝতে সবচেয়ে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, জরুরিভাবে আগামীদিনের নীতিগত পথনির্দেশনায় পরিবর্তনের প্রয়োজনও উপলদ্ধি করেছে। এসব দিকে উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে রয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। অন্যদিকে, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব গড়িমসির পেছনে আরও উপযুক্ত অর্থনৈতিক কার্যকরণ রয়েছে।
নীতিনির্ধারণীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ কেন্দ্রিক। প্রতিনিয়ত পণ্য সরবরাহ চক্রে সংকোচন ও কর্মী সংকটের ঘটনা এর অপরিসীম গুরুত্বকেই নির্দেশ করে। যা নিরসনের সমাধান ব্যাপক মাত্রায় অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও চাকরির সুযোগ সৃষ্টির মধ্যে নিহিত। পরিকল্পনার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে থাকলেও প্রতিনিধি পরিষদের (কংগ্রেস) বিভক্তি সময়মতো তা বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাজ্যও পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে পিছিয়ে রয়েছে ইউরো জোন।
বাধ্যতামূলক না হলেও তৃতীয় আবশ্যক নীতিটি হলো- আর্থিক বাজারে অতিরিক্ত ঝুঁকিগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করা, কারণ এটি সার্বিক অর্থনীতি ও সামাজিক কল্যাণকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এজন্য প্রয়োজন আরও মানসম্মত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ, বিশেষত ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক সংস্থার ওপর। জাতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিবিড় সমন্বয় ছাড়া এসব উদ্যোগ সফল হবে না। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি পরস্পর সম্পৃক্ত হওয়ায় ব্যর্থতার প্রভাব শুধু কোন দেশে নয় বরং বিশ্বজুড়ে পড়বে। কারণ, গেল (২০০৭-০৮) সালের আর্থিক মন্দার পর একটি দেশের আর্থিক সংস্থার গৃহীত ঝুঁকি যে পুরো পৃথিবীর দুর্দশার কারণ হয়ে, সেটাও এখন সবারই জানা।
সবশেষ নীতিটি বিশ্বের সকলের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সরবরাহ ও প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের অপরিহার্য পদক্ষেপ। আমরা দেখেছি মহামারির শুরু থেকেই সব দেশ সমানভাবে টিকার সরবরাহ পায়নি। অনেক উন্নয়নশীল এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে, যা ধনী অগ্রসর অর্থনীতিগুলোর জন্যও লজ্জাজনক। মনে রাখতে হবে, উন্নয়নশীল দেশের পিছিয়ে থাকার কারণেই ডেল্টা ভেরিয়েন্টের মতো মারাত্মক সংক্রামক ধরন সৃষ্টি হয়। বৈশ্বিক মহামারি চলাকালে কোন দেশকে বঞ্চিত করে, আমরা কেউই সুরক্ষিত থাকার আশা করতে পারি না। একইসাথে, জীবন ও জীবিকার ওপর কোভিডের অভিঘাত ন্যূনতম পর্যায়ে রাখাও একান্ত জরুরি। আরও আছে বিশ্বের কিছু দুর্বল রাষ্ট্রের ভেঙ্গে পড়া বন্ধে সহায়তা দানের দিকটি। যেমন- আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধস্ত দেশে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ অকার্যকর হলে, বিপুল অভিবাসীর বিশৃঙ্খল ঢল দেখে দেবে ইউরোপের দ্বারপ্রান্তে। মহামারি তাতে নতুন মাত্রা লাভ করতে পারে। অর্থাৎ, মহামারি মোকাবিলায় টিকার পাশাপাশি জি-২০ জোটের এবারের বৈঠকে বহুবিধ ভূরাজনৈতিক ঝুঁকির ব্যাপারে যথাযথ সিদ্ধান্ত আসা দরকার।
সর্বোত্তম ফলাফলের জন্য আলোচিত চারটি নীতিগত ক্ষেত্রকে আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যা সকলের জন্যই সমান গুরুত্বের, আর বাস্তবায়নের ইতিবাচক দিকই বেশি।
কিন্তু, অবহেলিত হলে দুর্দিনও দূরে নয়। সার্বিক অর্থনীতি, আর্থিক খাত, সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি নিরসনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কালক্ষেপণে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সমৃদ্ধি মারাত্মক হুমকিতে পড়তে পারে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়েই। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার চেষ্টাও তাতে ব্যাহত হবে।
- লেখক: ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট মোহাম্মদ এ. এল-এরিয়ান বহুজাতিক জার্মান আর্থিক সংস্থা আলিয়াঞ্জ এসই- এর প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। তিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কুইন্স কলেজের প্রেসিডেন্ট। তার লেখা দুটি বহুল সমাদৃত বই- 'দ্য ওনলি গেম ইন টাউন' ও 'হোয়েন মার্কেটস কোলাইড'
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত