পুতিনের শেষ উদ্দেশ্য স্নায়ুযুদ্ধের অপমানজনক পরাজয়ের বদলা নেওয়া
পুরো পৃথিবীর মনোযোগ এখন পূর্ব ইউক্রেনে, অঞ্চলটি ঘিরে ফেলছে মস্কোর অনুগত বাহিনী। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দৃষ্টি কিন্তু আরও দূরে নিবদ্ধ। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাও আরও সুদূরপ্রসারী। সহজভাবে বললে, স্নায়ুযুদ্ধে নিজ দেশের অপমানজনক পরাজয়ের পরিণতি মানতে পারেননি পুতিন। তিনি স্নায়ুযুদ্ধের পরিণতি থেকে নতুন ইতিহাসও সৃষ্টি করতে চান। যেখানে বিজয়ের 'ট্রফি' আনতে চান রাশিয়ার ঘরে।
গতকাল সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্নতাকামী দুটি রুশ ভাষাভাষী অঞ্চলকে স্বীকৃতি দেন পুতিন। তিনি সেখানে রুশ সেনা মোতায়েনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও করেছেন। তারপরই শুরু হয়েছে বড়-পরিসরে রুশ সমর শক্তির অবস্থান বদল। এ যেন ইউক্রেনে আগ্রাসনেরই পূর্ব প্রস্তুতি। এরপর কী হবে? রুশ সেনারা কী ওই অঞ্চল দুটিতেই থাকবে নাকি ইউক্রেনের আরও বড় অংশকে দখলে নেবে?- প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবে আসছে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ।
তবে একটি বিষয় সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পুতিন। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের নিরাপত্তা মানচিত্রের খোলনলচে তিনি যে বদলাতে আগ্রহী- তা নিয়ে কোনো রাখঢাক রাখেননি শুরু থেকেই।
গতকাল সোমবার (বাংলাদেশ সময় মধ্যরাত) ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাকামী দুটি অঞ্চলকে 'স্বাধীন' হিসেবে স্বীকৃতি দেয় মস্কো। এই ঘোষণাকালে পুতিন নিয়ে আসেন অতীত প্রসঙ্গ। বলেছেন, গত তিন দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্য শক্তিগুলো রাশিয়াকে অপমান করেছে। দেশটিকে দেয়নি একটি বৈধ পরাশক্তির প্রাপ্য মর্যাদা। অবহেলা করেছে মস্কোর স্বার্থ এবং ঝুঁকিতে ফেলেছে রুশ জাতির জাতীয় নিরাপত্তা।
এসব ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, "নিজ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার রাশিয়ার রয়েছে। আর সেটাই আমরা করব।"
ঘণ্টাব্যাপী এ ভাষণ এবং তার আগে বিগত এক মাস ধরে ইউক্রেন সংকটের পুরো সময়জুড়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেসব দাবিদাওয়া করেছেন তাতে প্রমাণিত হয়- পুতিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা অতীতকে নতুন রূপদানের মধ্যেই নিহিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর কালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সাথে ইউরোপের পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশগুলো গঠন করে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো। রাশিয়ার রাষ্ট্রনায়ক চান অবিলম্বে ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ বন্ধ হোক। তিনি একে রাশিয়ার প্রতি নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে একাই দেখেন না, বরং পুরো রাশিয়ার নিরাপত্তা কাঠামোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও একই ধারণা পোষণ করেন। অবশ্য তাদের সন্দেহের অবকাশ না থাকারই কথা। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানকালে পশ্চিমারা আর পুবমুখে (রাশিয়ার সীমান্তবর্তী সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোয়) ন্যাটোর বিস্তার না ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পুতিন ও রুশ অভিজাতদের স্থির বিশ্বাস, তারপর 'বেঈমানি' করেছে পশ্চিমারা- করেছে প্রতারণা।
তাই পুতিনের চাওয়া- যখন পূর্ব জার্মানিরও পতন ঘটেনি ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি সেই ১৯৯০ সালের সীমারেখায় ফিরে যাক। এই দাবি মানা আদৌ হবে কিনা- তা নিয়ে ঘোর সন্দেহের অবকাশ তো আছেই; তবে মানা হলে- স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের ওই দশকের অনেক বিস্ময়কর রদবদল আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। এতে অনেকাংশেই ঘুচবে স্নায়ুযুদ্ধে মস্কোর হারের গ্লানি। অন্ধকার যে অধ্যায়ের মুহূর্তগুলো আজো পুতিনের মতো সাবেক সোভিয়েত কর্মকর্তাদের তাড়া করে ফেরে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়াকে '২০ শতকের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়' বলেছেন পুতিন। ১৯৯১ সালে লৌহযবনিকার অবসান ঘটলে সদ্য স্বাধীন সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো ধীরে ধীরে পশ্চিমা ব্লকে যোগ দিতে থাকে। পোল্যান্ড, রোমানিয়া, লিথুনিয়া, লাটভিয়া ইত্যাদি দেশ ইইউ সদস্যপদ পেতে যোগও দেয় ন্যাটো জোটে। ওই সময়ে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শিকার রাশিয়া কেবল নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে বাধ্য হয়।
বিংশ শতক দেখেছে দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ, দেখেছে হলোকাস্টসহ বহু গণহত্যা। তবুও পুতিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলাটা গভীর অর্থপূর্ণ।
এজন্য ব্যথার কারণও বোঝা জরুরি। আসলে ১৯৯১ সালের পর দীর্ঘদিন পশ্চিমা আর্থিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল ছিল রাশিয়া। বলাইবাহুল্য, এসব অভিজ্ঞতা তাদের কাছে ছিল অসহ্য যাতনার। যা আরও ব্যথাতুর হয়ে ওঠে পশ্চিমাদের বিজয়োল্লাসে।
একটি পরাশক্তির আকাশ থেকে মাটিতে পতনের ওই বছরগুলো পুতিনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা আছে, এমনটাই বলেন জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ম্যারি সারোত্তে। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, বার্লিন দেওয়ালের পতনের সময় রুশ গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে জার্মানিতে ছিলেন পুতিন। বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলার সময়ে তাকে মস্কো ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সারোত্তে বলেন, 'রাশিয়ার এই নেতা এখন তার দেশের চারপাশে একটি বাফার জোন তৈরি করতে চান, ঠিক যেমনটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকার সময়। একইসাথে, তা করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুলনীয় একটি পরাশক্তির আসন ফিরে পেতে চায় মস্কো।
তার মতে, ন্যাটোভুক্ত সব দেশকে পাশ কাটিয়ে পুতিনের দৃষ্টিনিবদ্ধ কেবল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর, যা তার বেশকিছু চিন্তাচেতনা প্রকাশ করে। যেমন তিনি মনে করেন, বৈশ্বিক ইস্যুগুলোতে বিশ্ব শক্তিগুলোর অংশগ্রহণ থাকতে হবে, আর অবশ্যই তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে রাশিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক জোট- ওয়ারশ প্যাক্টের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহুবল- ন্যাটো। তাই রাশিয়াকে অবশ্যই নিজ উঠোনে অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে; ঠিক যেমনটা করা হতো সোভিয়েত যুগে।
ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক ইউরোপ ও রাশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক ফিওনা হিল মনে করেন, "রাশিয়া তার ইচ্ছেপূরণের ক্ষমতা চায়, আর সেজন্যই এতকিছু। ইউক্রেন কী চায় তার কোনো গুরুত্বই নেই, এমনকি পুতিন ইউক্রেনকে স্বাধীন কোনো দেশ বলেও মানেন না।"
গত জুলাইয়ে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার অধিকার তার লেখা এক প্রবন্ধে স্পষ্ট করে জানান পুতিন। সেখানে তিনি রাশিয়ান, ইউক্রেনীয় এবং বেলারুশীয়দের একই জনতা বলে উল্লেখ করেন, যাদের উৎপত্তি প্রাচীন নবম শতকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র 'রুশ' থেকে। তিনি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভকে বলেছেন সব রুশ শহরের জননী।
ফিওনা হিল বলেন, "শুধু ৩০ বছর রাশিয়ার সাথে অন্যায় হয়েছে তাই-ই নয়; পুতিন আরও মনে করেন, বহু শতক ধরে রাশিয়াকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। যার মধ্যে রয়েছে রুশ সাম্রাজ্য থেকে শুরু সোভিয়েত ইউনিউনের ওপর আসা আঘাত-ও।"
সদ্য সমাপ্ত মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মমেলনে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ যা বলেছেন তার সারমর্ম দাঁড়ায়, একজন ঐতিহাসিকের মতো অতীতে আঁকড়ে পড়ে আছেন পুতিন, তাই আমাদের (পশ্চিমা বিশ্বের) আশাবাদী হওয়ার সুযোগও তেমন নেই।"
শলৎজের মতে, "বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সীমা নির্ধারিত হয়েছে কেবল তা মেনে নেওয়ার মাধ্যমেই ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।"
পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণ
অতীতের বিশ্লেষণ করে অনেক মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্বের সাবেক কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, ১৯৯০ এর দশকে মস্কোর সাথে সুসম্পর্ক রক্ষায় যত্নশীল ছিল না যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। একইসাথে, স্নায়ুযুদ্ধে জেতা নিয়ে বিজয়োল্লাসে যথেষ্ট বাড়াবাড়িও করা হয়েছে।
তাদের অনেকেই মনে করেন, ইউরোপের নিরাপত্তা চুক্তিগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। উভয়পক্ষে কারচুপির অভিযোগ এনে সোভিয়েত আমলে করা অনেক অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ চুক্তির বরখেলাপ করা হয়েছে। তাই মস্কোকে আবার এমন চুক্তির আলোচনায় ফেরাতে হবে। তবে তারা পুতিনের ইচ্ছেনুযায়ী ন্যাটো জোটের বিস্তারকে আগের যুগে ফিরিয়ে আনার পক্ষেও নন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের কালে মস্কোতে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রড্রিক ব্রেথওয়েইট বলেন, "সন্দেহ নেই ৯০ এর দশকে মস্কোর সাথে পশ্চিমাদের কূটনীতি যথেষ্ট উদ্ধতপূর্ণ ও অনুপযুক্ত ছিল। এখন আমরা তারই মূল্য দিচ্ছি। কিন্তু সেকারণেই পুতিন যুদ্ধ বাধানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে মনে হয় না।"
বর্ষীয়ান এ কূটনীতিকের মতে, পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী নয়। "পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ন্যাটোর আকার বৃদ্ধি এবং রুশ ও ইউক্রেনীয় জাতির ঐতিহাসিক যোগসূত্র হিসেবে যেসব কথা বলেছেন- তা তিনি একা নন বরং রাশিয়ার লাখ লাখ নাগরিকও বিশ্বাস করেন।"
- সূত্র: দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল