দুর্যোগের সময় নেতৃত্বগুণে এগিয়ে নারীরা: গবেষণা
নারীদের পেশা অথবা কর্মস্থলে অগ্রগতি নিয়ে কথা বলতে গেলে একটি বহুল প্রচলিত উপমা হলো 'গ্লাস সিলিং' বা কাঁচের ছাদ। কোন নারী যখন কোন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে আসীন হবার উপক্রম হয়, তখন অদৃশ্য এক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। কাঁচের মত একেও চোখে দেখা যায় না।
গ্লাস সিলিংয়ের মত, নারী নেতৃবৃন্দের ক্যারিয়ার প্রসঙ্গে আলোচনায় সাদৃশ্যপূর্ণ যে প্রত্যয়টির উল্লেখ করা হয় তা হলো 'গ্লাস ক্লিফ' বা কাঁচের চূঁড়া। যখন কোন প্রতিষ্ঠান কোনরূপ সংকটের মুখোমুখি হয়, তখন এর ত্রাণকর্তা হিসেবে একজন নারীকে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর যখন নারীকে উচ্চপদে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ দেয়া হয়, তখন তাকে এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয় যা ইতোমধ্যে বিগড়ে আছে, এবং যেখানে সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
আমাদের মাথায় তাই এই প্রশ্নটি বারবারই উঁকি দেয়, সত্যিই কি নারীরা সংকটের সময় নেতৃত্ব দিতে অধিকতর পারদর্শী? এজন্যই কি তাদের হাতে সাম্রাজ্য সঁপে দেয়া হয় এর সবচাইতে কঠিনতম মুহূর্তর্টিতে!
কোভিড-১৯ সংকট চলাকালেও আমরা বিশ্বের নারী নেতৃত্ববৃন্দের সাফল্যগাঁথা শুনতে পেয়েছি এবং এরই প্রেক্ষিতে আমাদের এ গবেষণা। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সংক্রমণের সংখ্যা এবং মৃতের সংখ্যা উভয়ের বিচারেই যেসব দেশে নারীরা ক্ষমতার শীর্ষে রয়েছেন, সেখানে কোভিড-১৯ দুর্যোগের ক্ষতি কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। আরেকটিতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের গভর্ণরদের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়েছে; এখানেও একই ফলাফল। নারীশাসিত রাজ্যগুলোতে মৃতের হার কম। আমরা তাই মূল্যায়নের ভিত্তিতেই বৈশ্বিক ডাটাবেজ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম যে, কোভিড-১৯ সংকট নিরসনে সংগঠনের ভেতর নারী এবং পুরুষ অধিকর্তার গৃহীত পদক্ষেপে কতখানি পার্থক্য রয়েছে।
সংকটে নেতৃত্ব দিতে কাকে অধিকতর যোগ্য হিসেবে দেখা গেছে
গত বছর আরেকটি সমীক্ষায় আমরা নারী এবং পুরুষ সহকর্মীদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে কে বেশি যোগ্য নেতা সেটি তুলে এনেছিলাম। আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম বিশ্বের প্রায় ৬০ হাজার নেতার ভেতর থেকে ( যার মধ্যে ২২, ৬০৩ জন নারী এবং ৪০, ১৮৭ জন পুরুষ) । কোভিড-১৯ সংকট শুরুর প্রাক্কালেও আমরা একই রকম মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেই।
এ বছরের মার্চ থেকে জুনের মাঝামাঝি আমরা আমাদের 'এক্সট্রাঅর্ডিনারি লিডার ৩৬০ ডিগ্রি এসেসমেন্ট' এর ভিত্তিতে ৪৫৪ জন পুরুষ এবং ৩৬৬ জন নারীর নেতৃত্বগুণ নিরীক্ষা করি। আগের সমীক্ষার ধারাবাহিকতায় এবারেও দেখা যায়, নারী নেতৃবৃন্দ তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভাল অবস্থানে রয়েছে।সামগ্রিক রেটিংয়েও নারীদের কার্যকর নেতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বরং মহামারীর সময়ে পুরুষ ও নারী নেতৃবৃন্দের মাঝের ব্যবধান বেড়েছে কয়েক দফা। যা নির্দেশ করে যে, নারীরা সংকটের সময় অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখেন।
১৯টির ভেতর ১৩টি মূল্যায়ন সূচকেই নারীরা পুরুষদের চাইতে এগিয়ে ছিল। প্রযুক্তিগত বা পেশাদারি কর্মদক্ষতা সূচকে পুরুষরা এগিয়ে থাকলেও দৃশ্যত তেমন কোন পরিসংখ্যানগত পার্থক্য চোখে পড়ে নি।
নিচের এই সারণীতে মহামারীর প্রথম পর্যায়ে নারী এবং পুরুষের সংকট মোকাবিলার দক্ষতা অনুসারে একটি গড় রেটিং উপস্থাপন করা হয়েছে-
কেন নারী নেতৃবৃন্দ অধিকতর কার্যকর
সমীক্ষার তালিকাভুক্ত প্রত্যেক নেতাই একটি 'এমপ্লয়ী এনগেজমেন্ট স্কোর' গ্রহণ করে। কর্মচারী এবং সহকর্মীদের প্রতি তাঁরা নিবেদিত এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল তার ভিত্তিতে এই প্রতিক্রিয়া নথিভুক্ত করা হয়। পুরুষ নেতাদের সাথে কর্মরতদের সংশ্লিষ্টতা, নারীদের সাথে একই রকম সংশ্লিষ্টতার অনেক কম ছিল। অর্থাৎ নারী নেতৃবৃন্দ তাদের কর্মীদের সাথে অনেক বেশি সক্রিয়। পুরুষ এবং নারী উভয় নেতৃবৃন্দের জন্য গড় সংশ্লিষ্টতার হার ছিল শতকরা ৫১ ভাগ।
কেন এই তফাৎ তা বুঝতে আমরা নজর দেই মহামারীর সময়ে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের ভিত্তিতে নির্ণীত আরও কিছু সূচকে। উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা, শক্তিশালী যোগাযোগ, সমন্বয় এবং দলগত কাজ, সম্পর্ক বিনির্মাণ প্রভৃতি অনেক আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগগুণে এগিয়ে ছিলেন নারীরা। পূর্বে উল্লিখিত যুক্তরাষ্ট্রের গভর্ণরদের ওপর চালিত গবেষণায়ও ঠিক এটিই প্রতিফলিত হয়েছিল। নারী গভর্ণররা ভাইরাসের আশংকা এবং সচেতনতা অধিক ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন যা তাদের অনুগামীদের ভাইরাস নির্মূলের বিধিনিষেধ মেনে চলতে সাহায্য করেছে; মানুষের সুস্থতার জন্য তাদের উদ্বেগ বেশি মাত্রায় চোখে পড়েছে এবং তাদের পরিকল্পনাও ছিল সুস্পষ্ট।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এসব ডেটার মাধ্যমে আমরা জানতে এবং বুঝতে পারছি প্রকৃতপক্ষে এই মুহূর্তে মানুষ তাদের নেতাদের কাছে কী প্রত্যাশা করে। আমাদের সংগৃহীত ডেটা বলে, যারা নতুন দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম, কঠিন সময়েও যারা নিজেদের কর্মচারীদের মূল্যায়ন করতে ভুলে না, যারা সততা এবং দৃঢ়তার প্রদর্শন করে, সর্বোপরি যারা সংবেদনশীল, মানুষের দুর্দশা, সংকট, বিষন্নতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে সক্ষম-মানুষ দুর্যোগে তেমন নেতাই প্রত্যাশা করে।
গবেষণা বলছে, এই চারিত্রিক প্রকাশ নারীদের ভেতরেই বেশি প্রবল। তবে যেভাবে মহামারীর ছায়া আমাদের উপর বিরাজ করে আছে, তাতে নারী-পুরুষ যেই হোন না কেন, প্রতিটি নেতার প্রধান কর্তব্য এখন একে দমন করা।
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ অবলম্বনে