আলঝেইমার প্রতিকারে যুগান্তকারী লেকানেমাব
আলঝেইমারের ফলে মস্তিষ্কের কোষ ধ্বংসের গতি কমিয়ে আনতে সক্ষম এমন ঔষধকে আবিষ্কার করায় একে যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক হিসেবে মত দিয়েছে। কয়েক দশকের ব্যর্থতা শেষে গবেষণাটি আলঝেইমার প্রতিকারের এক নতুন যুগ সূচনা করেছে, যেখানে আলঝেইমারের সবচেয়ে সাধারণ রূপ ডিমেনশিয়াও প্রতিকার করা সম্ভব। খবর বিবিসির।
যদিও লেকানেমাব নামের ঔষধটির প্রভাব খুবই সীমিত এবং এর কার্যকারিতা নিয়েও বিতর্ক আছে। এছাড়াও ঔষধটি কাজ করে রোগটির প্রথম পর্যায়ে। অর্থাৎ, রোগটিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রথমেই রোগ ধরতে না পারলে ঔষধটির সুবিধা পাবে না।
আলঝেইমারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে বেটা অ্যামিলয়েড নামের এক ধরনের আঠালো আস্তরণ পড়ে। লেকামেনাব এই আস্তরণকেই আক্রমণ করে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যর্থ হওয়ার পর ট্রায়ালে এই সাফল্য গবেষকদের মনে আশার আলো দেখাচ্ছে। আলঝেইমারস রিসার্চ ইউকে তাদের এই ফলাফলকে 'যুগান্তকারী' হিসেবে অভিহিত করেছে।
৩০ বছর আগে অ্যামিলয়েডকে লক্ষ্য করে গবেষণার সূচনা ঘটানো প্রফেসর জন হার্ডি একে বলেছেন 'এক ঐতিহাসিক' মাইলফলক হিসেবে, এবং লেকামেনাবের ব্যাপারে বেশ আশাবাদ দেখিয়েছেন। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টারা স্পিরেস-জোনসও ফলাফলকে মত দিয়েছেন বেশ বড় ব্যাপার হিসেবে, "কারণ আমরা দীর্ঘদিন ধরেই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হচ্ছিলাম।"
বর্তমানে, আলঝেইমার রোগীদের অন্যান্য ঔষধ দেওয়া হলেও কোনো ঔষধই তাদের লক্ষণের পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি, রোগেরও উন্নতি ঘটেনি। লেকানেমাব এক ধরনের অ্যান্টিবডি, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসকে আক্রমণের জন্য যেটি ব্যবহার করা হয়, ঠিক সেটিই রোগীর মস্তিষ্ক থেকে অ্যামিলয়েড পরিষ্কারের জন্য রি-ইঞ্জিনিয়ার করা হয়েছে।
অ্যামিলয়েড এক ধরনের প্রোটিন যেটি মস্তিষ্কের নিউরনের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় জমা হয় এবং বিভিন্ন ধরনের আকার গঠন করে। আলঝেইমার রোগীদের একটি সাধারণ লক্ষণ এটি।
১৭৯৫ জন স্বেচ্ছাসেবী প্রাথমিক পর্যায়ের আলঝেইমার রোগীদের ওপর প্রতিরাতে লেকানেমাব প্রয়োগ করা হয়। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশ হওয়া ফলাফলে অবশ্য আলঝেইমার সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যাবে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে যা পাওয়া গিয়েছে সেটিও কম নয়। ১৮ মাসের চিকিৎসার পর দেখা যায় আলঝেইমার তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা আরও কমিয়ে দিলেও এই গতি প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গিয়েছে।
এই ডেটা ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ঔষধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছে যে লেকামেনাবকে আদৌ সাধারণ পর্যায়ে ব্যবহার শুরু করা যাবে কিনা সে ব্যাপারে। ঔষধটির প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এইসাই অ্যান্ড বায়োজেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা আগামী বছরের মধ্যেই অন্যান্য বেশ কিছু দেশ থেকে এটি বাজারজাত করার অনুমতির প্রক্রিয়া শুরু করবে।
৭৮ বছর বয়সী ইংল্যান্ডের কেন্ট থেকে আসা আলঝেইমার রোগী ডেভিড এসাম আন্তর্জাতিক ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করে। তার আলঝেইমারের ফলে তিনি আসবাবপত্র কীভাবে বানাতে হয় কিংবা যন্ত্রপাতি ব্যবহার কীভাবে করতে হয় তা ভুলে গিয়েছেন। এমনকি ঘড়ি দেখতেও ভুলে গিয়েছেন তিনি, যার ফলে সময় দেখার জন্য এখন তাকে ডিজিটাল ঘড়ির ওপর নির্ভর করতে হয়। ডেভিডের স্ত্রী শেরিল জানিয়েছেন, "তার স্মৃতি এখন নেই বললেই চলে।" তবে ঔষধটির সাফল্য তাদেরকে আশা দেখাচ্ছে। ডেভিডের বক্তব্যানুযায়ী, "যদি কেউ আলঝেইমারের গতি কমিয়ে ফেলতে পারে, তবে বিষয়টি দারুণ হবে। এটা খুবই বাজে জিনিস।"
ডেভিডের মতো আলঝেইমার রোগী সারা পৃথিবীজুড়ে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি রয়েছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে সেটি ১৩.৯ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
কোনো পরিবর্তন কি আসবে?
লেকানেমাবের 'বাস্তব প্রভাব' নিয়ে গবেষক এবং ডাক্তারদের মধ্যে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রথমত, ঔষধটির ফলে অবস্থার উন্নতি হলেও এর পরিমাণ খুব কম। স্বাভাবিক অবস্থা থেকে চূড়ান্ত ডিমেনশিয়া অবস্থার ১৮-পয়েন্ট স্কেলের মধ্যে ঔষধটির প্রভাব মাত্র ০.৪৫ স্কেল পরিমাণ। প্রফেসর স্পিরেস-জোনস রোগের ওপর ঔষধটির 'কম প্রভাব' আছে স্বীকার করলেও তিনি বলেন, "নাটকীয় পরিবর্তন না হলেও আমি এটি গ্রহণ করবো।" আলঝেইমার্স রিসার্চ ইউকের আরেক গবেষক ড. সুসান কোলহাস জানান, "এর প্রভাব কম হলেও অন্তত এটি আমাদের গবেষণায় পা রাখার জায়গা করে দিয়েছে।" পরবর্তী প্রজন্মের ঔষধগুলো আরও ভালো হবে বলে জানান তিনি।
অবশ্য এই ঔষধের ঝুঁকিও কম নয়। মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা যায়, ১৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে, মস্তিষ্ক ফুলে উঠেছে আরও ১৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর। সামগ্রিকভাবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য ৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর ওপর ঔষধ প্রয়োগ বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
নর্থ ব্রিস্টল এনএইচএস ট্রাস্টের এলিজাবেথ কুল্টহার্ড, যিনি আলঝেইমার রোগীদের চিকিৎসা দেন, জানান যে, আলঝেইমার রোগীরা রোগে কিছুটা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে ছয় বছর পর্যন্ত নিজেরা চলাফেরা করতে পারে। যদি এই গতি ২৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, তবে রোগীর স্বাভাবিক চলাচল আরও ১৯ মাস বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। তবে এই সময়সীমা নিয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আলঝেইমারে আক্রান্ত হওয়ার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই এই ঔষধ কাজ করে। কারো আলঝেইমার হয়েছে কিনা তা জানতে হলে মস্তিষ্ক স্ক্যান করে অথবা স্পাইনাল ফ্লুইড বিশ্লেষণ করে তা জানতে হয়। তবে বর্তমানে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ আলঝেইমার রোগীই এই টেস্ট করেছেন। বাকিদের হয় এই টেস্ট করানোর মতো অর্থ হাতে নেই অথবা টেস্ট করানোর সুযোগ-সুবিধা নেই। ড. কুল্টহার্ড জানান যে, "কেবল বড় মেডিকেল সেন্টারের আশেপাশে থাকা এবং আলাদাভাবে অর্থ খরচ করা ব্যক্তিরাই এ থেকে সুবিধা পাবে।"
এছাড়াও অন্যান্য গবেষকরা জানিয়েছেন অ্যামিলয়েড বাদেও আলঝেইমারের লক্ষণ আরও বিস্তৃত। কেবল অ্যামিলয়েডের দিকে নজর দিলেই আলঝেইমার প্রতিকার হবে না।
অ্যামিলয়েড ছাড়াও টাউ নামের আরেকটি প্রোটিন রয়েছে, যেটি মৃত মস্তিষ্ককোষের কাছাকাছি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রফেসর স্পিরেস-জোনস জানিয়েছেন, "আমি অনেক আশাবাদী যে আমরা সমস্যাটির কিছুটা হলেও ধরতে পেরেছি। আগামী এক দশকের মধ্যেই আমরা আরও বড় পরিবর্তন নিয়ে আসার মতো কিছু বের করতে পারবো।"