দুই কোরিয়ার সীমানার মাঝামাঝি জাদুঘর, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে থাকেন তত্ত্বাবধায়ক!
শিল্পের সবসময়ই একটা অন্য রকম ক্ষমতা আছে বলেই আমরা জানি। অনেক সময় এই শিল্প হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক কিছু। কিন্তু সম্প্রতি চালু হওয়া একটি জাদুঘর যেন সেই বিপদকে সর্বোচ্চ সীমায় নিয়ে গেছে।
বলা হচ্ছে 'ইউনিমারু' নামের একটি জাদুঘরের কথা। ইউনিমারুর অবস্থানই এটিকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। বলা যায়, অনেকটা হাঙরের মুখের কাছে পা বাড়ানো। কোরিয়ান ডিমিলিটারাইজড জোন (ডিএমজেড) বা কোরীয় নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চলে এই জাদুঘরের অবস্থান। ডিএমজেড একটি নো ম্যান'স ল্যান্ড যা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়াকে আলাদা করেছে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ইউনিমারু জাদুঘরের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনীর দিন '২০২১ ডিএমজেড আর্ট অ্যান্ড পিস প্ল্যাটফর্ম' শিরোনামে ৩২ জন শিল্পীর ৩৪টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয় এখানে।
শিল্পের আস্তানা হওয়ার আগে এই জাদুঘরটি ছিল একটি কাস্টমস হাউস। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত যারা এখানে আসতেন, তাদেরকে সিকিউরিটি স্ক্রিনিং এর ভেতর দিয়ে যেতে হতো। এরপর এটিকে আরও বড় পরিসরের অফিস হিসেবে তৈরি করা হয়।
চলতি বছরের শুরুর দিকেও এই জায়গাটি ছিল একদম ফাঁকা। তখন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এমপিএআরটি এখানে জাদুঘর তৈরির প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে আসে। ইউনিমারু জাদুঘরের নাম দেওয়া হয়েছে দুটি কোরীয় শব্দের সমন্বয়ে। 'ইউনি' শব্দের অর্থ এক এবং 'মারু' শব্দের অর্থ জায়গা।
দুই দেশের মাঝামাঝি অবস্থিত হওয়ায় এবং দুই দেশের উত্তপ্ত সম্পর্কের কারণেই নিরাপত্তাজনিত কারণে জাদুঘরটিতে সবসময় সীমিত সংখ্যক দর্শণার্থী প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। দৈনিক সর্বোচ্চ ৫টি দল এই জাদুঘর ঘুরে দেখতে পারে এবং প্রতিটি দলে মানুষের সংখ্যা ৩০ জনের বেশি হতে পারবে না।
ইউনিমারু জাদুঘরে যেতে হলেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হবে আপনাকে। প্রথমেই যেতে হবে দক্ষিণ কোরিয়া পুনরেকত্রীকরণ মন্ত্রণালয়ে। সেখান থেকে ইউনিমারুতে যাওয়ার অনুমোদন সংগ্রহ করার পর ভ্রমণেচ্ছুক প্রার্থীদের ডিএমজেড অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ বাস দেওয়া হবে।
এরপর আইডি পরীক্ষার পালা। আইডি পরীক্ষার পর এমওইউ এর অধীনে কর্মরত গাইড এবং স্টাফরা অতিথিদের জাদুঘর পর্যন্ত নিয়ে যাবেন। এসব স্টাফদের সবাই বেসামরিক নাগরিক এবং তারা সঙ্গে কোনো অস্ত্র বহন করেন না।
ইউনিমারু জাদুঘরে যেতে হলে পোশাকের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিধিনিষেধ। মিনি স্কার্ট, শর্টস এবং ক্যামোফ্লেজ প্রিন্টের যেকোনো পোশাক পরে এখানে যাওয়া নিষেধ। শুধু তাই নয়, ৮ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুও এই জাদুঘর পরিদর্শনে যেতে পারবে না।
অঙ্গভঙ্গি এবং চলাফেরার ক্ষেত্রেও মেনে চলতে হবে কিছু নিয়ম। ইউনিমারু জাদুঘরে প্রবেশের পর কাউকে দেখে আপনি হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানাতে পারবেন না কিংবা অনুমতি ছাড়া কোনোকিছুর ছবিও তুলতে পারবেন না। জাদুঘরের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই এ সমস্ত নিয়ম তৈরি করেছে কর্তৃপক্ষ।
২০১৮ সালে ডিএমজেডের পানমুনজমের 'পিস হাউস'-এ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ারম্যান কিম জং উনের মধ্যে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় মুন এবং কিম আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিরোধের ইতি টানার সিদ্ধান্তে আসেন; যদিও এখনো পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলছেই। এছাড়া, চুক্তিতে আরও উল্লেখ ছিল যে দুই দেশই 'মিলিত নিরাপত্তা অঞ্চল (জেএসএ)' থেকে অস্ত্র, প্রহরী এবং ল্যান্ডমাইন সরিয়ে নিবে।
এরপর কিছু সামরিক ওয়াচপয়েন্ট থেকে প্রহরী সরিয়ে নেওয়ার পর ইউনিমারু জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সীমান্ত থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরের কিছু গার্ড টাওয়ারে শিল্পকর্ম প্রদর্শনের অনুমতি পায়।
ইউনিমারু জাদুঘরের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর ইউন শিম চুং জানান, গার্ড টাওয়ারগুলোতে শিল্পকর্ম প্রদর্শন করত গেলে তিনি কিংবা তার সহকর্মীদের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে যেতে হয়।
জাদুঘরটিতে দক্ষিণ কোরিয়া এবং আন্তর্জাতিক, দুই ধরনের শিল্পীদের কাজই রয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জাদুঘরের ভেতরে একটি ফাঁকা ফ্রেমও রেখে দিয়েছে। তাদের প্রত্যাশা, এই ফাঁকা ফ্রেমে একসময় উত্তর কোরিয়ার কোনো শিল্পীর শিল্পকর্ম স্থান পাবে।
জাদুঘরের উজ্জ্বল নীলরঙা কনফারেন্স কক্ষের কারণে ডিএমজেড অঞ্চলে পানমুনজম এলাকাটিই সবার আগে চোখে পড়ে। তাই এখানে দর্শনার্থীর সংখ্যাও অনেক বেশি।
১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে ডিএমজেড অঞ্চল পরিদর্শনে এসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ডিএমজেডকে পৃথিবীর মধ্যে 'সবচেয়ে ভীতিপূর্ণ স্থান' বলে অভিহিত করেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার কড়া কোভিড নিষেধাজ্ঞার কারণে জুলাই মাসে ইউনিমারু জাদুঘরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও, গত ৩০ নভেম্বর থেকে আবারও স্বরূপে ফিরে এসেছে পানমুনজম।
সূত্র: সিএনএন