ভাষা শিখতেও চ্যাটজিপিটি!
গত কয়েক মাসে অনলাইন জগতের সাথে যুক্ত থাকলে আপনি নিশ্চিতভাবেই চ্যাটজিপিটি শব্দটির সাথে পরিচিত হয়েছেন। প্রযুক্তি আর শিক্ষাজগতে আলোড়ন তুলে ফেলা এই নতুন প্রযুক্তি যদি আপনি এখনো ব্যবহার না করে থাকেন, দ্রুত শুরু করুন।
চ্যাটজিপিটি কীভাবে ভাষাশিক্ষার ওপর প্রভাব ফেলবে, স্কুলের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের জন্য কী কী সুবিধা-অসুবিধা বয়ে আনবে কিংবা ভবিষ্যতে ভাষাশিক্ষা কিংবা শিখনপদ্ধতির ওপর কী প্রভাব ফেলবে, সেগুলো জানার আগে জেনে নেওয়া যাক এটি আসলে কী।
চ্যাটজিপিটি কী?
চ্যাটজিপিটি এমন এক কথোপকথন করার বট, যেটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের উত্তর দেয়। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখা এবং ডেটাবেজ স্ক্যান করতে সক্ষম এটি, যার ওপর ভিত্তি করে এটি বিভিন্ন ফরম্যাটে তার উত্তর দিতে পারে। কী ফরম্যাটে উত্তর দিবে তা সাধারণত একে কী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে। রচনা, কৌতুক, কবিতা, গল্প থেকে শুরু করে ভাষাশিক্ষার পরিকল্পনা পর্যন্ত বহু ফরম্যাটেই উত্তর দিতে সক্ষম এটি।
২০২২ সালের নভেম্বরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এই প্রযুক্তিকে। ইউবিএস-এর জরিপ অনুযায়ী, তারপর থেকে তিন মাসের মধ্যে এটি ১০ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারী ছুঁয়ে ফেলেছে বলে ধারণা করা হয়েছে। জানুয়ারি মাসে গড়ে প্রতিদিন ১ কোটি ৩০ লক্ষ নতুন ব্যবহারকারী এই প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে। ইন্সটাগ্রামকে ১০ কোটি ব্যবহারকারীতে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আড়াই বছর।
জেনারেটিভ এআই-এর একটি অন্যতম উদাহরণ চ্যাটজিপিটি। যেসব এআই সহজে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে নতুন কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে, সেসব এআইকে নির্দেশ করার জন্য এই 'জেনারেটিভ এআই' শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কেবল টেক্সটই নয়, অডিও, কোড, ছবি কিংবা ভিডিও উৎপাদন করা এআই-ও এর অন্তর্ভুক্ত। তবে সমস্যা হলো, এ ধরনের প্রযুক্তির শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক অংশকে ধসিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে।
অন্যান্য প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মতো চ্যাটজিপিটি নিয়েও অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নকল করার আশঙ্কায় এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তবে প্রফেসর ইথান মলিকের মতো অনেক শিক্ষাবিদই চ্যাটজিপিটি এবং অন্যান্য এআইকে ব্যবহার করে কোনো বিষয় আরও ভালোভাবে শেখা যায় তা পরীক্ষা করতেই এসব এআইকে নিজেদের কোর্সে সংযুক্ত করেছেন।
এআইয়ের মাধ্যমে ভাষা শিক্ষা
জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তির প্রভাব কোন কোন খাতে পড়বে সেগুলকে মোটাদাগে চারভাগে ভাগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সেগুলো হলো:
১। কন্টেন্ট তৈরি
চ্যাটজিপিটির মতো এআইগুলো প্রচণ্ড গতিতে এবং প্রচুর পরিমাণে কন্টেন্ট তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। যেহেতু একে কী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে এটি কী পরিমাণে এবং কোন বিষয়ে উত্তর দেবে, তাই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা একে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট কন্টেন্ট ব্যবহার করার সুবিধা নিতে পারে।
যেমন: জার্মান ভাষা শিক্ষক ক্লডিয়া শোয়েঙ্ক চ্যাটজিপিটির সহযোগী এআই টুল ডাল.ই-এর মাধ্যমে ছবি তৈরি করে তার শিক্ষার্থীদের জন্য জার্মান ব্যাকরণ আরও সহজে বোঝাতে পারছেন। স্প্যানিশ শিক্ষক ক্রিস ঝিংলিও চ্যাটজিপিটি কীভাবে ব্যবহার করে কীভাবে শিক্ষার্থীদেরকে একটি নির্দিষ্ট ক্রিয়াপদের নির্দিষ্ট ব্যবহার করতে হয়, সেটি অনুশীলন করার প্রশ্ন তৈরি করেছেন। যদিও চ্যাটজিপিটির দ্রুত ফলাফল দেখে তিনি খুশি, তিনি জানান যে এই উত্তর পেতে তার প্রশ্নকে খুব ভালোভাবে সময় নিয়ে সাজাতে হয়েছে।
২। ব্যক্তিগতকরণ বা পার্সোনালাইজেশন
কন্টেন্ট তৈরি ছাড়াও প্রত্যেক শিক্ষার্থী কীভাবে ভাষা শিখবে তাও নির্ধারণ করা সম্ভব চ্যাটজিপিটির মতো এআইয়ের সাহায্যে। তাছাড়া অন্যান্য ভাষায় অনুবাদেও সক্ষম এগুলো, ফলে ব্যবহারকারীরা বেশ কিছু ভাষায় এআই ব্যবহার করতে সক্ষম। যেমন: পলিগ্লট নামের একটি ল্যাঙ্গুয়েজ চ্যাটবটের সাথে ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং চিনা ভাষায় কথা বলা সক্ষম।
স্পিক নামের আরেকটি অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ভাষায় চ্যাটবটের সাথে কথা বলতে পারবে, যার ফলে অন্যপাশে কোনো মানুষকে বসে থাকতে হবে না। এআইটি শিক্ষার্থীদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া এবং স্বাভাবিক ভাষায় কথা বলতেও সক্ষম এগুলো। যেহেতু এআইগুলো ক্রমাগত নিজে নিজেই শিখে নিজেদের উন্নতি ঘটাচ্ছে, তাই উত্তর ও ফিডব্যাকেও উন্নতি দেখা যাবে শীঘ্রই।
৩। সৃজনশীলতা
কন্টেন্ট তৈরি ছাড়াও এআই 'ঐতিহ্যগত সৃজনশীল' ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনছে। এআই দিয়ে তৈরি নতুন টুলগুলোর সাহায্যে সাধারণ জনগণ খুব সহজেই অ্যাপ থেকে শুরু করে পডকাস্ট কিংবা ভিডিও তৈরি করে ফেলতে পারছেন।
ভাষা শিক্ষক এবং ভাষা শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অবারিত সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এটি। এডুগোডটএআইয়ের মতো টুলগুলোর সাহায্যে খুব সহজেই যে কেউ গেমিফাইড ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স বানিয়ে ফেলতে পারবে। প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে কোর্স ডিজাইন শুরু করেছে এবং প্রায় ৫০ হাজার আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারী ইতিমধ্যেই এটি ব্যবহার করছে।
৪। কাজের চাপ কমানো
অনেক শিক্ষকই চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে এটি ব্যবহার করে কাজের চাপ কমানো সম্ভব, বিশেষ করে কী কী শেখানো হবে তার পরিকল্পনা করার মতো একঘেয়ে ও দীর্ঘসময়ব্যাপী কাজ। স্টিফেন লকইয়ার নামে এক ভূগোল শিক্ষক জানান, "অবশ্যই আমি আমার পুরো ক্লাস চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে নেবো না, এটি যে নিখুঁত তাও বলছি না আমি। তবে এটা কাজকে অনেকখানিই সহজ করে দিয়েছে।"
এআই টূলগুলোর পক্ষে থাকা শিক্ষাবিদরা জানান, এটি শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করে ফেলবে না, বরং এর মাধ্যমে চলমান শিক্ষাব্যবস্থার ফাঁকফোকরকে ঠিক করা সম্ভব। যেমন: একঘেয়ে, বিরক্তিকর কাজ, যেগুলো প্রযুক্তি দিয়েই করা সম্ভব, সেগুলো দ্রুত এই টুলগুলোকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষকদের সময় বাঁচাতে পারবে। এর ফলে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জন্য আসলেই যে জিনিস প্রয়োজনীয় এবং প্রযুক্তি যেগুলো বুঝতে পারবে না, যেমন প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শেখার অবস্থা বা ব্যক্তিগত উন্নয়ন, সেদিকে মনোযোগ দিতে পারবে।
বন্ধু নাকি শত্রু?
ব্রুকিংস ইন্সটিটিউটের এক প্রতিবেদনে চ্যাটজিপিটির লাভ-ক্ষতি নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পর উপসংহারে লেখা হয়: "যদি ঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে চ্যাটজিপিটি ক্লাসরুম এবং শিক্ষার্থীদের জন্য এক চমৎকার টুল হতে পারে, ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়।"
এডটেকের টনি ওয়ান জানান, "অনেকেই একে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অ্যাকাডেমিক ইন্টেগ্রিটির মধ্যকার এক অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে দেখছেন। তবে বাস্তবে, এই দুটোই সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হবে, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং প্রযুক্তিবিদেরা এর মাধ্যমে শেখানো, চিন্তা করা, শেখার নতুন নতুন উপায় তৈরি করবেন।"
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সানাকোর স্টিফেন লকইয়ার একই ধরনের মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, "আমরা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে জেনারেটিভ এআই নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তন করার চেষ্টা চালাচ্ছি। 'দেখো প্রযুক্তি কী করেছে', এর বদলে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি, 'দেখো আমি প্রযুক্তি দিয়ে কী করেছি' সেটি।"
সূত্র: সানাকো