চ্যাটজিপিটির কারণে যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল অনলাইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জায়ান্ট চেগ
যেখানে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন বোঝার চেষ্টা করছে কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাদের ব্যবসার ধরণ পরিবর্তন করবে, সেখানে অনলাইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জায়ান্ট চেগ চেষ্টা করছে এর প্রথম বড় শিকার না হওয়ার।
চেগ বহু বছর ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য হোমওয়ার্ক সাহায্য বা প্লেজিয়ারিজম পরীক্ষার সম্ভাব্য টুল হিসেবে পরিচিত ছিল। মহামারির সময়ে ভার্চুয়াল শিক্ষার দিকে সরে যাওয়ায় এর সাবস্ক্রিপশন এবং স্টকের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল।
তবে এরপর বাজারে আসে চ্যাটজিপিটি। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ, দ্রুত এবং ফ্রি সমাধান নিয়ে হাজির হওয়ায় চেগ ৫ লাখেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার হারিয়েছে, যারা প্রতি মাসে ১৯.৯৫ ডলার পর্যন্ত অর্থ দিয়ে উত্তর সংগ্রহ করত এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সহায়তা নিত।
চেগের স্টক মূল্য ২০২১ এর শুরুর থেকে ৯৯ শতাংশ কমে গেছে এবং প্রতিষ্ঠানটি বাজারে ১৪.৫ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের বন্ড ট্রেডাররা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তারা আর তাদের ঋণ পরিশোধ করার জন্য যথেষ্ট আয় করতে পারবেন কি না।
নিহাম ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের একটি জরিপে দেখা গেছে যে, ৩০ শতাংশ কলেজ শিক্ষার্থী এই সেমিস্টারে চেগ ব্যবহার করতে চান, যা বসন্তে ছিল ৩৮ শতাংশ। এবং ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে চান, যা বসন্তে ছিল ৪৩ শতাংশ।
চেগ-এর নতুন সিইও নাথান শুলজ প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আরও ব্যাপক সেবা দেয়ার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি বলছেন, "আপনি যদি বাধা পান, তবে আপনাকে আপনার সেরা কাজের ওপর দৃষ্টি দিতে হবে।"
ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়েস-এর গবেষকরা একটি গবেষণায় দেখতে পান, শিক্ষার্থীরা পূর্বে যে-সব 'প্লেজিয়ারিজম হাব' যেমন চেগ ব্যবহার করত, সেগুলো ছেড়ে চ্যাটজিপিটি ব্যবহারে ঝুঁকেছে।
ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়েস-এর কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রফেসর ক্রেগ জিলেস বলেছেন, " মনে হচ্ছিল, তারা সম্পূর্ণভাবে অনলাইনে সমাধান খোঁজার এবং সেগুলো কপি করার প্রক্রিয়া থেকে সরে গিয়ে চ্যাটজিপিটিতে দিয়ে সমাধান তৈরি করানোর দিকে চলে গেছে।"
চেগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, "আমরা আমাদের প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার করতে চাওয়া যেকোনো প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিটিংয়ের অভিযোগের তদন্তে সহযোগিতা করি এবং এমন কার্যকলাপ প্রতিরোধে আমাদের প্রযুক্তি ও সমাধানে বিনিয়োগ করি।"
তবে এ ব্যাপারে ওপেনএআই মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
একদিনে চ্যাগ-এর শেয়ারের ৪৮ শতাংশ পতন
চেগের ব্যবসা গত বছর করোনা পরবর্তী সংকটের মুখে পড়ছিল এবং কর্মীরা এআই টুলস উন্নয়নের জন্য অনুরোধ করেছিল। তবে চেগের নেতৃত্ব প্রথমে তা প্রত্যাখ্যান করেছিল।
চ্যাটজিপিটি আসার পর কিছু চেগ কর্মী ভেবেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি চ্যাটবটের ভুল উত্তরের কারণে বিপদে পড়বে না। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে চেগের অভ্যন্তরীণ তথ্য দেখায়, শিক্ষার্থীরা চ্যাটজিপিটিকে পড়াশোনার সহায়ক হিসেবে অনেক বেশী মাত্রায় ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা দেখতে পান, জিপি-৪ এর দেওয়া কিছু উত্তর চেগের মানব বিশেষজ্ঞদের উত্তরগুলোর চেয়ে ভাল স্কোর করছিল। এই সময়েই চেগের সাবেক ড্যান রোশেনবাগ ওপেনএআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যানের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তারা চেগমেট নামে একটি সার্ভিস ডেভেলপ করার সিদ্ধান্ত নেন। এটি চেগের উত্তর সংগ্রহ ও জিপি-৪ ব্যবহার করে ছাত্রদের প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে এবং কুইজ তৈরি করতে সাহায্য করত।
চেগমেটের পরীক্ষার পর রোশেনবাগ মে মাসে এক আর্নিং কলের সময় বলেন, চ্যাটজিপিটি তাদের কোম্পানির সাবস্ক্রাইবার বৃদ্ধি কমিয়ে ফেলেছে। চেগ বছরের বাকি সময়ের জন্য আর্থিক পূর্বাভাস তুলে নেয় এবং তাদের শেয়ারের দাম একদিনে ৪৮ শতাংশ পড়ে যায়।
পরবর্তী আর্নিং কলের সময়ে রোশেনবাগ বলেন, চেগমেটের নাম আর ব্যবহার করা হবে না এবং তিনি স্কেল এআই-এর সঙ্গে একটি নতুন অংশীদারিত্ব ঘোষণা করেন। এটি চেগকে একাধিক অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিনে ২৪টিরও বেশি এআই সিস্টেম তৈরি করতে সাহায্য করার কথা ছিল।
সম্প্রতি, চেগের শীর্ষ কর্মকর্তারা চেগমেট থেকে নিজেদের আলাদা করে নিয়ে সেটির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন।
শুলজ সাক্ষাৎকারে বলেন, "আমরা চেগমেটকে নিয়ে একটা বিল্ডিং থেকে ফেলে দেব। এটা কখনও কিছু ছিল না।"
চ্যাটজিপিটির অনুকরণ
প্রতিষ্ঠানটি স্কেল এআই-এর সাথে মিলে এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করেছে, যা আগে থেকেই বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে করা হোমওয়ার্ক এবং পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দেয়। তারা তাদের ওয়েবসাইটও পুনর্নির্মাণ করেছে, যা চ্যাটজিপিটির মতো দেখতে একটি টেক্সটবক্স দিয়ে দর্শকদের অভ্যর্থনা জানায়।
ওপেনএআই অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারকারীর কাছে "আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?" এমন প্রশ্ন করে এবং চেগের হোমপেজ এখন প্রশ্ন করে, "আজ আপনি কী সাহায্য চান?"
চেগের অটোমেটেড উত্তরগুলোর মাধ্যমে এটি এখন মানুষের তৈরি উত্তরগুলোর চেয়ে এক চতুর্থাংশ খরচে হোমওয়ার্কের উত্তর দিতে পারছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে, এই নতুন সরঞ্জামগুলো গ্রাহক হারানোর প্রবণতা এখনও কমাতে পারেনি।
চেগ দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১১ শতাংশ রাজস্ব কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। এটি ২০১৭ সালের পর প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় বার্ষিক পতন। ওয়াল স্ট্রিট বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয় প্রান্তিকে আয়ের প্রতিবেদনে ১৫ শতাংশ বিক্রয় কমেছে দেখাবে।
সৌদি আরবের তায়েফ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আহমেদ আসালমি সম্প্রতি চেগে সাবস্ক্রাইব করেছিলেন একটি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার সাহায্যের জন্য। তবে, তিনি চেগের সমাধান দেখে হতাশ হন। সেখানে নিচে লেখা ছিল, "তাৎক্ষণিক উত্তরগুলো বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ, চেগের শেখানো কনটেন্ট বা ওপেনএআই-এর প্রশিক্ষিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল থেকে আসে।"
তিনি বলেন, "আমাকে ঠকানো হয়েছে।" তিনি চ্যাটজিপিটি থেকে পাওয়া উত্তর আরও পছন্দ করেন এবং নিয়মিত অ্যাকাডেমিক কাজের জন্য ব্যবহার করেন।
চেগ বলেছে, তাদের ৯১ শতাংশ ব্যবহারকারী পণ্য নিয়ে সন্তুষ্ট। শুলজ বলেন, চেগ চায় এমন শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে, যারা চ্যাটবট থেকে সহজে পাওয়া উত্তর ছাড়া আরও কিছু চাইছে।
তিনি বলেন, "আমরা প্রতিষ্ঠানকে একটি রোডম্যাপ দিয়েছি, যা সঠিকভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযুক্ত করে আমাদের জন্য। এখন আমরা এক্সিকিউশন মোডে [পরিকল্পনা বাস্তবায়ন] আছি।"