অপেশাদার বিনিয়োগকারীদের তাড়নায় ফুলেফেঁপে বেড়েছে ওয়ালস্ট্রিটে ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারের দর
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র 'বিগ অ্যাপল' খ্যাত নিউইয়র্ক মহানগরের ওয়ালস্ট্রিট। এ সড়কেই আছে বৃহৎ সব বিনিয়োগ ব্যাংক ও স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যালয়। পেশাদার বিনিয়োগকারী আর বাণিজ্যিক সংস্থার বিশ্লেষকদের ভিড়েই নিয়ন্ত্রিত হয় বাজারের গতিবিধি।
কিন্তু, তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে আপাতত বেশভালো মুনাফা করছেন নব্য কিছু বিনিয়োগকারী। তারা পেশাদার পুঁজি লগ্নিকারী নন, আসল পেশাও একেক ধরনের। যাদের মধ্যে আছেন; আবাসন ব্যবসায়ী, প্রাক্তন বাবুর্চি, ধর্মযাজক থেকে শুরু করে হাইস্কুলের ছাত্র পর্যন্ত বিচিত্র শ্রেণির অনেকে।
তারা পুঁজিবাজারে এসেছেন দ্রুত ধনী হওয়ার গুজব প্রভাবিত হয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ধারণাটি ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। অনেকেই এবার ওয়ালস্ট্রিটকে নিজের খেলাতেই একহাত দেখিয়ে দেওয়ার স্বপ্নেও উজ্জীবিত। এদের মতো লাখো অনভিজ্ঞ ও নব্য বিনিয়োগকারীর জোটবদ্ধ অবস্থানে আপাতত হারতে বাধ্য হচ্ছেন ওয়ালস্ট্রিটের অভিজ্ঞ ও পেশাদার বিনিয়োগকারীর দল। এই মুহূর্তে অন্তত তাদের জয়রথ থামার কোনো চিহ্ন নেই।
তবে সমস্যা হলো, এসব বিনিয়োগকারী জোট বেঁধে ও অনলাইনে শলা-পরামর্শ করে এমন কিছু কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করছেন, যাদের বাজার অবস্থান বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও নব্য বিনিয়োগ পেয়ে ফুলেফেঁপে বেড়েছে তাদের বাজারদর।
যেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ আসছে, তাদের অনেকেই বাজারে দীর্ঘদিন ধরে আছে, এবং পেশাদার বিনিয়োগকারীদের কাছে সেখানে লগ্নী আকর্ষণীয় নয়। যেমন; ব্ল্যাকবেরির শেয়ারমূল্য চলতি বছরে বেড়েছে ২৮০ শতাংশ। প্রেক্ষাগৃহ চেইন এএমসি'র দর বেড়েছে ৮৪০ শতাংশ। বড় বিনিয়োগকারীরা যেসব কোম্পানিতে সম্ভাবনা একেবারেই দেখেন না, সেগুলোর বাজার অবস্থান শক্তিশালী করেই যেন ক্ষুদ্রেরা ছুঁড়ে দিয়েছে চ্যালেঞ্জ।
তবে, যে কোম্পানির কারণে ক্ষুদ্র মানব আর অতিকায় দানবের লড়াইটি সবচেয়ে বেশি সামনে আসছে; সেটি হলো- গেমস্টপ। এককালে যুক্তরাষ্ট্রের শহরতলীর বাইরে বিপণীকেন্দ্রগুলোতে বেশ জমিয়েই ব্যবসা করতো ভিডিও গেম রিটেলারটি। ব্যবসার সেই সুদিন না থাকায় আর্থিক সঙ্কটেই ছিল কোম্পানিটি। কিন্তু, ক্ষুদ্র ও অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীর দল এখানে বেশ বড় আকারের পুঁজি লগ্নী করেছেন।
ওয়ালস্ট্রিটে স্বতন্ত্র বিনিয়োগকারীদের এই বাজি 'ডাম্ব মানি' বা নির্বোধের মতো পুঁজি নিবেশ হিসেবেই পরিচিতি। কারণ, বিশ্লেষকদের মতে এটি এমন এক জুয়া যেখানে হার প্রায় নিশ্চিত। সবচেয়ে বড় কারণ, প্রতিষ্ঠিত বিশ্লেষক সংস্থার আভাস অবজ্ঞা করে এবং বড় বিনিয়োগকারীদের যেখানে একদম আস্থা নেই; সেখানেই জমেছে বাজির আসর।
নব্য এসব স্বতন্ত্র বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগকে অনুপ্রাণিত করে 'ওয়ালস্ট্রিট বেটস' নামক সামাজিক মাধ্যম রেডিট- এর একটি পেজ। গুজব আর ভ্রান্ত আভাসে ভরা এই পেজ, পুঁজিবাজারে অভিজ্ঞতাহীনদের ধারণা দিয়েছে যে, তারা চাইলেই গেমস্টপে বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভবান হতে পারবেন। অথচ ওয়ালস্ট্রিটের প্রতিষ্ঠিত দুটি হেজফান্ডের আভাস গেমস্টপের শেয়ারে বড় দরপতন। তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়েই কোম্পানিটির বাজার অবস্থান রাতারাতি যেন বদলে দিয়েছেন গুজবতাড়িত অপেশাদার বিনিয়োগকারীর দল।
শুধু হেজফান্ডগুলো নয়, জীবিকার জন্য পুঁজি ব্যবসায় জড়িত এমন বাজার ব্যবস্থাপকেরাও গেমস্টপের দরপতন অনিবার্য বলে ধরে নেন। দরপতনে লাভের আশাও করেন তারা। সে আশার গুড়ে বালি দিয়ে অনলাইনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা একে নিয়ে গেছেন সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। ফলে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে মাত্র ২শ' কোটি ডলার থেকে গেমস্টপের বাজার মূল্যায়ন উন্নীত হয় ২৪শ' কোটি ডলারে। গেল বছরের ডিসেম্বরের পর সার্বিক স্ফীতি বেড়েছে অবিশ্বাস্য ১৭শ' শতাংশ! আর গত মঙ্গল ও বুধবার এই দুদিনের মধ্যে মূল্যায়ন বাড়ে ১ হাজার কোটি ডলার!
অনলাইন সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকলে মিলে এক মজার খেলায় যেন রূপ নিয়েছে 'গেমস্টপ' এ বিনিয়োগের উন্মাদনা। প্রতিদিনই তাতে যোগ দিচ্ছেন নতুন অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীর দল। চলতি সপ্তাহে টেসলা নির্বাহী ইলন মাস্ক রেডিট পেজটি নিয়ে এক টুইট করার পর- তা যেন আরও দ্বিগুণ উৎসাহে বেড়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী একে মনে করছেন সুবর্ন সুযোগ।
তাদেরই একজন উইসকনসিনের ১৬ বছরের হাইস্কুল শিক্ষার্থী বেন পিট। গেমস্টপে বিনিয়োগ করে ইতোমধ্যেই সে সাড়ে ৭শ' ডলার লাভ করেছে। তার মতে, ওয়ালস্ট্রিটের সেরা বিশ্লেষকদের টেক্কা দিয়ে সকলে মিলে উল্টো পথে চলে সফল হওয়ার মধ্যে এক দারুণ উত্তেজনা কাজ করে। আর সেই রোমাঞ্চের সঙ্গী হতেই তার মতো অনেক কিশোর ট্রেডার যোগ দিয়েছে একদলে।
"এটি অর্থ উপার্জনের সেরা উপায়। তার সঙ্গে হেজফান্ডগুলোকে দেখিয়ে দেওয়া যে তারা ভুল প্রমাণিত হতে পারে," জানায় বেন। সে আরও বলে, এটা অনেকটা হেজফান্ডগুলোকে তাদের নিজেদের খেলাতেই হারিয়ে দেওয়ার মতো উত্তেজক।
এই খেলা কোথায় শেষ হবে, তা কেউ জানে না। তবে কিছু বিশ্লেষকের মতে, এতে পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রির এক বড় জোয়ার আসবে, যাতে এই লেনদেনে হেজফান্ডগুলোই পরাজিত হতে পারে। আর এমনটা হলে, বাধ্য হয়েই তাদের আওতাধীন নানা কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে ক্ষতিপূরণে নামতে হবে। যার অর্থ বাজারে বড় ধরনের ধ্বস সৃষ্টি করবে, হেজফান্ডের পরাজয়।
বাজার মূল্যায়ন নিয়ে এই পার্শ্বআলোচনার মধ্যেই গত বুধবার শীর্ষ পাঁচশ' মার্কিন কোম্পানির সামগ্রিক বাজার সূচক এসঅ্যান্ডপি- ৫০০' আড়াই শতাংশের বড় দরপতন লক্ষ্য করে। গেল বছরের অক্টোবরের পর এটিই ছিল সূচকটির সবচেয়ে বাজে অবস্থান। তার পেছনে অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থনীতির মন্দাবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তার আভাসই ছিল মূল কারণ।
মার্কিন অর্থনীতি যখন মহামারির অভিঘাত নিয়ে অস্থির, ঠিক সেই মুহূর্তেই বাজারে গণহারে শেয়ার বিক্রির জোয়ার বিপজ্জনক হতে পারে। মজার খেলা পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতাকে হত্যার মতো প্রাণঘাতী রূপ নিতে পারে।
এব্যাপারে ইন্টারঅ্যাকটিভ ব্রোকার্সের প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ সসনিক বলেন, "বাজারের অস্থিতিশীল অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে, লাভজনক সংস্থার শেয়ার বিক্রি করতেও বাধ্য হন। এই খেলার পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য। কারণ, বেলুনের মতো বাজারে ঝুঁকিপূর্ণ অংশে যতবেশি স্ফীতি আসবে, ঠিক ততোবড় আকারেই আসবে ধ্বস। কিন্তু, সেটা কখন হবে, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।"
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস