আকিজেও ম্যাজিকের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চলেছেন আলমগীর
'৯০ এর দশকে যখন 'অ্যারোমেটিক হালাল সোপ' বাজারে এলো, তখন তা রীতিমত 'সেনসেশন' তৈরী করেছিল। যমুনা গ্রুপের এই পণ্যটি অচিরেই অন্য সব সাবানের ব্র্যান্ডকে ছাড়িয়ে যায়; বাজারে এর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা অন্যান্য কোম্পানির নাভিশ্বাস উঠতে থাকে।
পরে একসময় ব্র্যান্ডটি মোটা অঙ্কের বিনিময়ে হাত বদল হয়, কিন্তু যমুনার জন্য সৈয়দ আলমগীর একে যতটা সফল করে তুলেছিলেন, তেমন করে আর কেউ পারে নি। ভুল মানুষের হাতে পড়ে শেষ পর্যন্ত সাবানের ব্র্যান্ডটি আর টিকতেই পারে নি।
তবে আলমগীরের সাফল্যগাঁথা কিন্তু সেখানেই থামেনি। তিনি পরবর্তীতে এসিআইতে যোগ দেন এবং এর কনজ্যুমার প্রডাক্টগুলোকেও বাজারের বেস্ট-সেলিং ব্র্যান্ডের কাতারে নিয়ে আসতে সক্ষম হোন। সে ধারাবাহিকতায়ই আমরা দেখি কীভাবে একসময়ের শীর্ষে থাকা ডেটলকে হটিয়ে বাজার দখল করে নেয় এসিআইয়ের জীবাণুনাশক স্যাভলন।
নতুন প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন নিয়ে আরও একবার বাজার মাত করতেই যেন মার্কেটিং জিনিয়াস সৈয়দ আলমগীর এবার যোগ দিয়েছেন আকিজ ভেনচারে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপচারিতায় সৈয়দ আলমগীর জানিয়েছেন তার অনুপ্রেরণা আর স্বপ্নের গল্প।
টিবিএস: আপনি এসিআই কোম্পানি ছেড়ে কেন আসলেন?
সৈয়দ আলমগীর: ২২ বছর ধরে এসিআইতে ছিলাম, সেখানে কাজ শুরু করেছিলাম এক্সিকিউটিভ হিসেবে। পরবর্তীতে আমি সেখানে ম্যানেজিং ডিরেক্টর পর্যন্ত হই। এসিআই কোম্পানিতে কাজের পরিধি ছোট ছিল, ছোট একটি কোম্পানি ছিল। মাত্র দুইটি প্রোডাক্ট ছিল তখন- স্যাভলন ও এরোসল; কোম্পানির তখন বার্ষিক টার্নওভার ছিল ৮ কোটি টাকা। ঐ কোম্পানি আমি রেখে আসার সময় বার্ষিক টার্নওভার ৩ হাজার কোটি টাকায় উপনীত হয়।
খাদ্যপণ্য ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত এসিআইয়ের সকল সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান আমার নিজ হাতে গড়া। এগুলো করার পর দেখলাম যে মোটামোটি কোম্পানিটি ম্যাচিউরড, কোম্পানিতে আমি লিডারশীপ তৈরি করেছি।
আমি থাকা অবস্থাতেই কোম্পানিটিকে ভাল একটা অবস্থানে নিয়ে গেছি। কোম্পানিটিতে আমি এমনভাবে সম্পৃক্ত হই যে আশেপাশের মানুষ মনে করতো আমিই কোম্পানিটির মালিক, যার কারণে অন্য কোন কোম্পানি আমাকে চাকুরির অফারও করত না। তারপর একদিন অফার পাই যমুনা কোম্পানি থেকে। শেয়ারসহ অফার করায় যমুনা কোম্পানিতে যোগ দিয়েছি।
সর্বশেষ আমি আকিজ কোম্পানির মালিকের অনুরোধে কৌতূহলবশত তাদের ফুডের ফ্যাক্টরিতে ঘুরতে যাই। ঘুরে দেখলাম কোম্পানির কলেবর অনেক বড়; বড় বড় ফিল্ড, মেশিনারিজগুলো উন্নত মানের, জার্মানি, চায়না ইত্যাদি দেশ থেকে আমদানি করা, যা দেশে অন্য কারো কোম্পানির কাছে খুব একটা নেই। কিছু কিছু মেশিন আছে যা বিশ্বে আছে মাত্র চারটি, এশিয়াতেই আছে মাত্র তিনটি।
তারপর দেখলাম যে কোম্পানিটি এমন কিছু ভালো জিনিস বানাচ্ছে যে মালিক নিজেই জানেন না, যেমন উদাহরণস্বরূপ আকিজ কোম্পানিতে যে ফ্রুটিকা জুস বানাচ্ছে তাতে কোন ধরণের প্রিজারভেটিভ নাই, যা অন্য যে কোন কোম্পানির পণ্যেই সাধারণত থেকে থাকে।
এই ফ্রুটিকা তৈরি হয় এসেপটিক পদ্ধতিতে, অন্য সবগুলো কোম্পানি এ ধরণের পণ্য তৈরি করে গরম করে সাধারণত। আর আমাদের এই পণ্যটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেশিনের মাধ্যমে বের হয়ে যায় এবং ব্যাকটেরিয়াগুলো মেরে ফেলে। হাতের স্পর্শ ছাড়াই ফ্রুটিকা তৈরি করা হয়, এগুলো তৈরি করতে কমলা আনা হয় ব্রাজিল থেকে ও দুধ ব্যবহার করা হয় কোন কিছু না মিশিয়েই। তবে এর জন্য মেশিন বাবদ ব্যয় করতে হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা, অথচ অন্যান্য কোম্পানি ২০-৩০ কোটি টাকার নরমাল মেশিন দিয়েই এই পণ্য বানাচ্ছে। জনাব আকিজ সাহেবের নৈতিকতা ধরে রেখে তার বর্তমান উত্তরাধিকার ছেলেরা সকল পণ্যের যথাযথ সততা ও পণ্যের মান নিশ্চিত করছে; তারা কোন ধরণের প্রতারণার আশ্রয় নেন না।
তারপর আকিজের মালিকপক্ষ আমাকে সম্মানজনকভাবে আকিজ কোম্পানিতে যোগ দিতে অফার করে, সর্বশেষ গত ছয় মাস আগে আমি আকিজ কোম্পানিতে যোগ দেই।
টিবিএস: আকিজ কোম্পানির অনেক বেশি বিনিয়োগ করার কথা ছিল, আপনি আকিজ কোম্পানিতে আসার পর কি কি বিনিয়োগ নিয়ে এসেছেন; যেমন: আকিজ ফুড, ডেইরি, ইলেকট্রনিক্স, ইকোনোমিক জোন, এগ্রো এন্ড লাইভস্টক, কেমিক্যাল, হেলথকেয়ার, ট্রেডার্স, লাইফ ইন্সুরেন্স, ফেয়ারভ্যালু, আলাদিনডট.কম ও কমোডিটি ট্রেনিং ইত্যাদির প্রজেক্টগুলোর কি অবস্থা?
সৈয়দ আলমগীর: এসব প্রজেক্টগুলোতে ইতোমধ্যে ৭ হাজার লোক কর্মরত রয়েছে, আরো ৫-৬ হাজার লোক নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ফুড, ডেইরি ও লাইফ ইন্সুরেন্স ইতোমধ্যে চলু হয়েছে। এছাড়াও এগ্রো এন্ড লাইভস্টক, কেমিক্যাল, হেলথকেয়ার, ট্রেডার্স, ফেয়ারভ্যালু এই প্রজেক্টগুলো সামনের দিনে বাজারে আসছে।
টিবিএস: হেলথকেয়ার, এগ্রো এন্ড লাইভস্টক ও ইলেকট্রনিক্স প্রজেক্টে আপনারা কী কী করতে চাচ্ছেন?
সৈয়দ আলমগীর: আসলে হেলথ কেয়ারে আমরা হেলফ বিষয়ক বিভিন্ন পণ্য বাজারে নিয়ে আসবো, এটা কোন স্বাস্থ্যসেবা না, বরং স্বাস্থ্য পণ্য। এছাড়াও এগ্রো এন্ড লাইভস্টক প্রজেক্টের আওতায় আমরা বড় বড় গরুর খামার করবো, ইতোমধ্যে আমাদের গরুর খামার রয়েছে, সেগুলোকেই আরো অনেক বড় করা হবে। এছাড়াও ইলেকট্রনিক্সের বিভিন্ন পণ্য বাজারে নিয়ে আসব, যেমন: লাইট, সুইচ, বোর্ড, সকেট ইত্যাদি। ইলেকট্রনিক্সে আমাদের বড় বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে, কারণ দেশের বড় একটা সংখ্যার নিম্ন আয়ের মানুষ এখনও ইলেকট্রনিক্স পণ্য সেবার আওতায় আসেনি।
টিবিএস: এসব প্রজেক্টগুলো আপনাদের কত কোটি টাকার ভেনচার?
সৈয়দ আলমগীর: আসলে আমি এই মূহুর্তে সঠিক বলতে পারছি না কত টাকার উদ্যোগ এবং কোম্পানির নিজস্ব কৌশল হিসেবে এটি আমি বলতে চাচ্ছিও না। তাছাড়া আমি এসেছি মাত্র ছয় মাস হয়েছে, তাই আমার পক্ষে সব কিছু সঠিকভাবে বলাও সম্ভব হবে না। তবে এটুকু বলতে পারি এসব প্রজেক্টের মধ্যে এখনো অনেক বড় বড় প্রজেক্টের উদ্যোগ নেয়া হবে।
টিবিএস: আকিজ যেসব ব্যবসা পরিকল্পনা নিয়ে আসছে সেখানে বাজারে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা, যেমন ইলেকট্রনিক্স এর বাজার, এ প্রতিযোগিতার ব্যাপারে আপনার পরিকল্পনা কী?
সৈয়দ আলমগীর: আসলে প্রতিযোগিতা ছাড়া কোন মার্কেটই নেই, আপনার জন্য কেউ জায়গা ছেড়ে দিবে না, যেমন ইতোমধ্যে আমরা কোক, প্রাণ ইত্যাদি কোম্পানির সাথে বাজারে প্রতিযোগিতায় আছি। আমরা মনে করি, আকিজ একটি বড় কোম্পানি, আকিজকে প্রতিযোগিতা করেই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হবে পণ্যের মান নিয়ে। তবে ইলেকট্রনিক্সে এখনও দেশের অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ বাজারেই আসে নি, তাদেরকে টার্গেট কাস্টমার ধরলে আমাদের এ খাতে ভালো একটা সম্ভাবনা রয়েছে।
টিবিএস: আপনাদের বড় একটা সিএসআর খাত রয়েছে যেমন স্কুল, ডেইরি ফাউন্ডেশন ইত্যাদি, এগুলোর কাজ কী?
সৈয়দ আলমগীর: প্রথমত আমাদের সিএসআর এর জন্য একটি আলাদা ট্রাস্ট-ই রয়েছে। এখান থেকে গরিব-অসহায় মানুষকে দান করা হয়। এছাড়াও ঢাকা ও ধামরাইতে সিএসআর খাতের অর্থ দিয়ে স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। সারাদেশে আকিজ কোম্পানি ইতোমধ্যে ২৫০টি মসজিদ নির্মাণ করে দিয়েছেন। এ খাতের বার্ষিক যাকাতের টাকা ইসলামিক শরীয়াহ অনুযায়ী, সামজিক খাত ও গরীব-অসহায় মানুষের জন্য ব্যয় করা হয়ে থাকে।
টিবিএস: আপনাদের ভিশন কী?
সৈয়দ আলমগীর: আমাদের লক্ষ্য হলো আকিজ কোম্পানিকে দেশের অন্যতম বড় কোম্পানিতে পরিণত করা। আকিজ সাহেবের মোরালিটি অনুযায়ী, দেশ-জাতির জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য সেবা দেয়া। আমরা বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনে লাগে এমন ৮-১০টি প্রডাক্ট বাজারে নিয়ে আসবো, যা হবে আকিজের স্ট্যান্ডার্ড সম্মত ও গুণাগুণসম্পন্ন পণ্য সেবা। আকিজের স্ট্যান্ডার্ড বলতে বুঝাতে চাচ্ছি যে, আমরা যে ড্রিংকস ও জুস তৈরি করছি সেগুলোর জন্যও চায়না মেশিন নয়, জার্মান মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে আপনি বলতে পারেন যে আমরা এখনও অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। আশা করছি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।
টিবিএস: টিবিএসকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ আলমগীর: টিবিএসকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।