আখাউড়া চেকপোস্টে করোনাঘাত: তিন মাসে সোয়া ২ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার
ভোরের আলো ফুটতেই শুরু হয় শ্রমিকদের কর্ম চাঞ্চল্য, একে একে জড়ো হতে থাকে পণ্যবোঝাই ট্রাক। আর সঙ্গে থাকে ভারতগামী যাত্রীদের কোলাহল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর ও আখাড়াউড়া আন্তর্জাতিক চেকপোস্টের এই চিত্র নিত্যদিনের।
সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মুখর থাকে স্থলবন্দর ও চেকপোস্ট। কিন্তু এখন সেখানে শুধুই প্রাচীর ঘেরা নীরবতা। নেই যাত্রীদের কোলাহল। অদৃশ্য করোনাভাইরাসের প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে চেকপোস্টের কার্যক্রম।
ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে টানা তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে চেকপোস্ট দিয়ে দুই দেশের সাধারণ যাত্রী পারাপার বন্ধ রয়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত অন্তত সোয়া দুই কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে প্রথম আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারতের আগরতলায় পণ্য রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ২০১০ সালের ১৩ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আখাউড়া স্থলবন্দর।
প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে আগরতলায় কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত এসব পণ্য আগরতলা থেকে সরবরাহ করা হয় ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত সাতটি রাজ্যে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এখন রপ্তানির পরিমাণ অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে।
অবশ্য বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে পণ্য আমদানি না করায় আখাউড়া স্থলবন্দর থেকে সরকারের কোনো রাজস্ব আয় হয় না। শুধুমাত্র পণ্য রপ্তানি থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স পেয়ে থাকে সরকার। তবে স্থলবন্দরের চেকপোস্ট থেকে প্রতি মাসে প্রায় এক কোটি টাকার রাজস্ব যায় সরকার কোষাগারে।
প্রতিদিন এ চেকপোস্ট দিয়ে গড়ে পাঁচশ যাত্রী ভারতে গমন করে থাকেন। আর ঈদ-কিংবা পূজার সময়টাতে প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশি যাত্রী গমন করেন ভারতে। প্রত্যেক যাত্রীকেই পাঁচশ টাকা করে ভ্রমণ কর দিতে হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন অন্তত আড়াই লাখ টাকার রাজস্ব আসে আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট থেকে।
তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের কার্যক্রম। গত ১২ মার্চ থেকে শুধুমাত্র কূটনীতিক, অফিসিয়াল, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন প্রকল্পের ভিসাধারীদের যাতায়াত সুবিধা রেখে বাকি সব ধরণের ভিসাধারীদের প্রবেশ বন্ধ রেখেছে আগরতলা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট কর্তৃপক্ষ।
চেকপোস্টে ঝুলানো এ সংক্রান্ত একটি নোটিশে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত যাত্রী পারাবার বন্ধ রাখার কথা উল্লেখ করা হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি যাত্রীদের ভারতে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি। বর্তমানে চেকপোস্ট ব্যবহার করে শুধুমাত্র ভারত ও বাংলাদেশে আটকা পড়া দু'দেশের নাগরিকদের দেশে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে।
আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের দেওয়া তথ্য মতে, গত জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়েছেন ১৪ হাজার ১৪৩ জন, আর ভারত থেকে বাংলাদেশ এসেছেন ১০ হাজার ৯৪৩ জন যাত্রী। এর বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ৭০ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ টাকা।
ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত গমন করেছেন ১৪ হাজার ৩৭৩ জন, ভারত থেকে এসেছেন ১১ হাজার ৮৪৭ জন। ওই মাসে সরকার যাত্রীদের ভ্রমণ কর বাবদ রাজস্ব পেয়েছে ৭১ লাখ ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা। মার্চ মাসে ভারতে গিয়েছেন সাত হাজার ১১৯ জন ও বাংলাদেশে এসেছেন পাঁচ হাজার ৯৪৪ জন।
আর মার্চ মাসে রাজস্ব আয় হয়েছে ৩৫ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা। এপ্রিল মাসে ভারতে কোনো যাত্রী গমন করেননি, শুধুমাত্র ৮৭ জন ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। এর ফলে এপ্রিল মাসে সরকার কোনো রাজস্ব পায়নি।
মে মাসে বাংলাদেশে আটকা পড়া ১০৫ জন যাত্রী ভারতে ফিরে গেছেন, আর ১৯৩ জন বাংলাদেশি নিজ দেশে ফিরেন। ওই মাসে সরকার মাত্র ৫২ হাজার ৫০০ টাকা রাজস্ব আয় করেছে আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট থেকে।
এদিকে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে দ্বিতীয়বাবের মতো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আখাউড়া স্থলবন্দরের রপ্তানি কার্যক্রম। গত ৭ জুন থেকে এ বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছিল ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। কয়েকজন বিএসএফ সদস্য ও কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ফলে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে প্রতিদিন প্রায় এক কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি থেকে বি ত হচ্ছিল বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।
প্রায় ৯দিন বন্ধ থাকার পর গত মঙ্গলবার থেকে আখাউড়া বন্দর দিয়ে আবারও শুরু হয় রপ্তানি কার্যক্রম।
স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী নেতা শফিকুল ইসলাম বলেন, বিএসএফ সদস্যসহ প্রায় তিনশজনের করোনাভাইরাসের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত পণ্য আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা।
''পরবর্তী সময়ে সবার পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় মঙ্গলবার দুপুর থেকে আবারও পণ্য আমদানি শুরু করেছে তারা। আজকে ১০ ট্রাক ভোজ্য তেল রপ্তানি হবে আগরতলায়'' যোগ করেন তিনি।
পণ্য রপ্তানি বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা যেমন প্রতিদিন প্রায় এক কোটি টাকার রপ্তানি থেকে বি ত হচ্ছেন, তেমনি যাত্রী পারাপার বন্ধ থাকায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। গত ১৩ মার্চ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত অন্তত সোয়া দুই কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। কবে নাগাদ যাত্রী পারাপার কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে সেটিও নিশ্চিত নয়। বিষয়টি আগরতলা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, এখন শুধুমাত্র দুই দেশে আটকা পড়া যাত্রীরা আখাউড়া ও আগরতলা চেকপোস্ট দিয়ে নিজ দেশে ফিরছেন। সাধারণ যাত্রী পারাপার বন্ধ থাকায় প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
''কবে নাগাদ যাত্রী পারাপার স্বাভাবিক হবে সে সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আগরতলা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট কর্তৃপক্ষ যখন চাইবে, তখনই যাত্রী পারাপার শুরু হবে'' বললেন মোহাম্মদ আলী।