আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়
দ্বিতীয় মেয়াদে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান পদে মনোনয়ন পেয়েছেন জেরোমি পাওয়েল। তার সহকারী বা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেয়েছেন ফেডের বোর্ড সদস্য লাইল ব্রেইনার্ড।
সোমবার (২২ নভেম্বর) মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাদের মনোনয়ন দেন। এর মাধ্যমে বিরোধী দল বা রিপাবলিকানদের ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী পাওয়েলের অভিজ্ঞতার ওপর মার্কিন অর্থনীতির দিকপালের ভূমিকা রাখার আস্থা দেখালেন প্রেসিডেন্ট।
চার বছরের প্রথম মেয়াদ শেষের আগেই দ্বিতীয় মেয়াদে মনোনয়ন পেলেন পাওয়েল।
হোয়াইট হাউজে মনোনিতদের সাথে সাক্ষাতের সময় বাইডেন বলেন, 'শাটডাউনের কাল পেরিয়ে আমাদের অর্থনীতি আবারো বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।' মহামারির চরম বিপদের মুহূর্তে পুঁজিবাজারের আতঙ্কিত ভাব দূর করতে পাওয়েলের 'বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণ' উল্লেখ করার পাশাপাশি তার নীতি সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সহায়ক হবে বলেও আস্থাপ্রকাশ করেন বাইডেন।
বাইডেন বলেন, 'আমাদের অর্থনীতিকে নেতৃত্বদানে পাওয়েলই সঠিক ব্যক্তি।'
যুক্তরাষ্ট্রে দলমত বিচারের ঊর্ধ্বে রাখা হয় ফেডের প্রধান নিয়োগ। এর ব্যতিক্রম করেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনিই পাওয়েলকে মনোনয়ন দেন। এরপর ৮৪-১৩ ভোটের ব্যবধানে সিনেট তার নিয়োগ চূড়ান্ত করে। সিনেটর কমলা হ্যারিস ও বর্তমানে বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট সে সময় এ নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন।
এই সিদ্ধান্ত আরও গুরুত্বপূর্ণ একারণে যে, পাওয়েল ১৯৭০ এর দশকের পর ফেডের মুদ্রানীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য টানা সংস্কার শুরু করেন তার প্রথম মেয়াদে। যা অব্যাহত রাখার বিষয়ে বাইডেন সবুজ সংকেত দিয়ে মহামারির সংকট থেকে উত্তরণে পাওয়েলকে বেছে নিলেন। অন্যদিকে ব্রেইনার্ড একজন ডেমোক্রেট।
প্রথা অনুসারে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফেডারেল রিজার্ভের বোর্ড অব গভর্নসের সাত সদস্যের মধ্যে একজনকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেন। কিন্তু এ মনোনয়ন সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর হয়।
সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য প্রেসিডেন্ট মনোনিত প্রার্থীকে আস্থাসূচক ভোট দিলে তার নিয়োগ চূড়ান্ত হবে। তবে এজন্য আগে প্রয়োজন সিনেট ব্যাংকিং কমিটির সমর্থন।
বর্তমানে এ কমিটির প্রধান হলেন ওহিও রাজ্য থেকে নির্বাচিত ডেমোক্রেট দলের সিনেটর শেরোড ব্রাউন। তিনি এর আগে পাওয়েলকে মনোয়ন দেওয়া হলে কমিটির প্রধান হিসেবে তার সমর্থন দানের কথা জানিয়েছিলেন। মনোনয়ন ঘোষণার পর শ্যারড ব্রাউনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা বিষয়টি হোয়াইট হাউজের একটি সূত্রের বরাতে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবিসি।
তবে ডেমোক্রেট দলের প্রভাবশালী সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন, শেলডন হোয়াইটহাউজ ও জেফ মার্কলি পাওয়েলের দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের বিরোধিতা করছেন।
ট্রাম্প ভেবেছিলেন পাওয়েল তার দলের সমর্থক হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিজের মর্জিমতো প্রভাবিত করতে পারবেন। কিন্তু, নির্দলীয় ঐতিহ্য রক্ষা করে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপের চেষ্টাগুলোকে ব্যর্থ করে দেন পাওয়েল। এনিয়ে ট্রাম্প তার ওপর এতোটাই ক্ষুদ্ধ হন যে একটি টুইট বার্তায় তিনি বলেন, 'আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু কে, ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান না চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং?'
তাই রিপাবলিকান দলের ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ আইনপ্রণেতারাও পাওয়েলের বিরোধিতা করতে পারেন।
তবুও পাওয়েলের দ্বিতীয় মেয়াদের পক্ষে সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট লাভের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট। আরেক প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস দলের ভেতরে ও বাইরের রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে বাইডেনের এ মনোনয়নকে সাধুবাদ জানিয়েছে।
ট্রাম্প পাওয়েলকে আমেরিকার শত্রু বলে উল্লেখ করে ব্যক্তিগত আক্রমণ অব্যাহত রাখলেও, তাতে প্রভাবিত হননি পাওয়েল। সুদহার বৃদ্ধির কারণে ট্রাম্প তাকে বহিষ্কার করতে পারেন জেনেও পিছু হটেননি তিনি। বরং তিনি মহামারির সংকট কালে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে প্রশংসিত হন।
পৃথিবীর আরেক প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক- ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। ১৬৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কেন্দ্রীয় আর্থিকখাত নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানের নাম প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে ঘোষণা করেন ব্রিটিশ সিংহাসনের অধিকারী রাজা/ রানি।
বর্তমানে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের পরিচালনা পর্ষদ বা কোর্ট অব ডিরেক্টর্সের সদস্য সংখ্যা ১২ জন। এই সংখ্যা সর্বোচ্চ ১৪ জন করার নিয়ম রয়েছে। যার মধ্যে পাঁচ জন বিভিন্ন নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের মধ্য থেকেই পরবর্তী গভর্নরের নাম সুপারিশ করে থাকেন। সাধারণত ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের দায়িত্বরত গভর্নর তার নির্বাহীদের ভেতর থেকে অভিজ্ঞ ও চৌকস কর্মকর্তাকে তার পরবর্তী উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তোলেন। এভাবে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পাশাপাশি, আর্থিক নীতির ধারাবাহিকতাও নিশ্চিত করা যায়।
উন্নত দেশগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গভর্নর নিয়োগে রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা । যেমন কানাডার আইনে লেখা আছে যে গভর্নরের অবশ্যই আর্থিক বাজার ও অর্থনীতি নিয়ে সম্পূর্ণ ধারণা থাকতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও অর্থায়ন ব্যবস্থা নিয়েও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
বাংলাদেশে এমন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা লঙ্ঘণের নজির দেখা যায়। বরং সরকারের পছন্দের ব্যক্তিই গভর্নর পদে নিয়োগ পেয়ে আসছেন। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানেও সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের রাজনৈতিক বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান করার নজির রয়েছে।
অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের মতে, অর্থশাস্ত্র এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ে গভীর জ্ঞান-সম্পন্ন ব্যক্তিদেরই অধিকাংশ দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান করে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম করা হলে তা দেশের সার্বিক অর্থনীতি সঠিকপথে পরিচালনা ব্যাহত করতে পারে।