ঈদের কেনাকাটায় হতাশ ব্যবসায়ীরা
পশু ক্রয়-বিক্রয়ের বাইরে ঈদ উল আযহায় সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় পেঁয়াজ-মশলাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে। গত ঈদের আগেও দৈনিক অন্তত ২০-২৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করতেন দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার কারওয়ান বাজারের পাইকারদার ভাই ভাই স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. রুবেল।
সোমবার পর্যন্ত এবারের দৈনিক বিক্রি ১২-১৫ লাখ টাকার বেশি উঠেনি বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান তিনি।
তিনি বলেন, "ঈদ উল আযহাকে কেন্দ্র করে পেঁয়াজ-রসুনসহ গরম মশলা ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। তবে এবার ঠিক উল্টো। আমাদের নিয়মিত কাস্টমাররা প্রায় সবাই আগের ঈদের অর্ধেক পণ্যও নিচ্ছেন না"।
ঢাকার বাইরেও চাহিদা অনেক কম বলে জানিয়েছেন দেশে সবচেয়ে বেশি ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিত সাহা।
দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "মানুষের আয় কমে যাওয়া ও সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় নিত্যপণ্যের চাহিদা অন্তত ৩০ শতাংশ কম। ঈদে চাল, তেল, চিনি, লবণ, মশলাসহ নানা পণ্যের একটা বড় মৌসুম থাকে। তবে এবার এখনো তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না"।
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে কিছুটা বিক্রি বাড়লেও দুঃখ বেড়েছে উৎপাদন ও ব্যবসার প্রায় সব খাতে। সরকার এক সপ্তাহের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবে পরিচালনার অনুমতি দিলেও তা কোনোভাবেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ভূমিকা রাখে নি বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
বেতন-ভাতা পরিশোধের টাকাই উঠেনি ফ্যাশন হাউজের
ফ্যাশন হাউজগুলোতে শুক্রবার-শনিবার ভিড় থাকলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী কারোই বিক্রি হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। স্বাভাবিক সময়ে ঈদের তুলনায় এ বিক্রি ৩০-৪০ শতাংশের মতোও নয় বলে জানিয়েছেন তারা। এক সপ্তাহ যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছে তাতে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ কষ্টকর বলেই বলে জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিজাইনারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও অঞ্জনসের মালিক শাহিন আহমেদ বলেন, "কোরবানীর ঈদ নিয়ে আমাদের সেভাবে টার্গেট থাকে না। এবার সাধারণ সময়ের ঈদের তুলনায় ৪০ শতাংশের বেশি বিক্রি হয় নি"।
দেশীয় পোশাক ব্র্যান্ড নীল ক্রাফটের মালিক মো. ইসমাইল বলেন, "যে বিক্রি হয়েছে তাতে শ্রমিক ও সাপ্লাইয়ারদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করাই যাবে না"।
ফার্নিচার ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সে ক্রেতা ফিরেনি
এক সপ্তাহের জন্য শো-রুম খুললেও সাড়া পায়নি ফার্নিচারসহ হোম অ্যাপ্লায়েন্স ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসায়ীরা।বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি ও দেশের সবচেয়ে বড় আসবাবপত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হাতিল ফার্নিচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান বলেন, "নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য না হওয়ায় কেউই ফার্নিচার কিনছেন না"।
তিনি বলেন, "নতুন বাড়ি বা সংসার গোছাতে মানুষ ফার্নিচার ও হোল অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য কেনে। করোনায় এসবের সবই বন্ধ। ফলে ঈদের আগে কয়েকদিন শো-রুম খোলা হলেও ক্রেতা পাওয়া যায় নি। অন্যান্য ঈদের তুলনায় এখন অন্তত ৮০ শতাংশ বিক্রি কম"।
শ্রমিকদের বেতন ও শো-রুম ভাড়াও মূলধন থেকে দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফার্নিচার ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক টার্নওভার হয়। এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষও অন্তত ১০ লাখের বেশি।
সুবিধা মেলেনি কনস্ট্রাকশন খাতে
এক সপ্তাহের জন্য ব্যবসা স্বাভাবিক হলেও এ সুবিধা মেলেনি কনস্ট্রাকশন খাতে। রিয়েল এস্টেট, রড সিমেন্ট, সিরামিকস সহ কোনো খাতেই বিক্রি বাড়েনি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, "মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে আগ্রহী না থাকায় এসব খাতে বিক্রি ছিল না"।
দেশের কনস্ট্রাকশন খাতের বড় প্রতিষ্ঠান মেট্রোসেম গ্রুপ। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহিদুল্লাহ বাংলাদেশ স্টিল মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই সপ্তাহে পশু কেনা ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে কিছুই কিনেনি মানুষ। ঈদের পর আবার লকডাউনের কারণে নতুন কনস্ট্রাকশন কাজেও কেউ হাত দেয়নি। ফলে এ খাতে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন তুলে দেয়ার সুবিধা মেলেনি"।
করোনার অনিশ্চয়তার কারণে সারাদেশের ডিলাররাও পণ্য নিচ্ছেন না বলে জানান তিনি।
দেশের আবাসন খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন হাউজিংয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, "এক সপ্তাহের স্বাভাবিকতায় একাউন্টস ছাড়া আর কোনো বিভাগের কর্মকর্তারা অফিস করেনি। নতুন কোনো অর্ডারই পাওয়া যায়নি"।
গাড়ি বিক্রয় স্বাভাবিক সময়ের এক-দশমাংশ
একেবারেই স্বল্প সংখ্যক গ্রাহক যাদের হাতে নগদ অর্থ আছে এবং এখনই গাড়ি প্রয়োজন তারাই কেবল সীমিত পরিসরে লকডাউন শিথিলের সময়টাতে গাড়ি কিনছেন।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, "গত বছর অর্থনীতিতে মহামারি আঘাত হানার পর থেকেই গাড়ির বিক্রি হ্রাস পেয়েছে"।
ঈদের আগে স্বাভাবিক সময়ের মাত্র ১০ শতাংশ বিক্রয়ে সীমাবদ্ধ উল্লেখ করে তিনি বলেন "সাম্প্রতিক সময়ের বিক্রয় হ্রাস, এই কয়েকদিনের শিথিলতায় পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না"।
মোবাইল ফোন ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য ক্রয়ে ভিড়
করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে দুই সপ্তাহের লকডাউন শেষে ৮ দিনের জন্য মার্কেট খুলে দেয়ায় মোবাইল ফোনের বিক্রি অনেক বেড়েছে। রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সসহ প্রায় প্রতিটি মার্কেটেই মোবাইল বিক্রির দোকান, শো-রুমে ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে ফ্রিজ-রেফ্রিজারেটরের শো-রুমেও।
ঢাকার ফার্মগেটে এসকোয়ার ইলেকট্রনিক্সের শো-রুমের ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম বলেন, "কয়েকদিন ধরে বিক্রি কিছুটা বেশি। তবে অন্যান্য কোরবানির ঈদের তুলনায় খুব কম"।
মোবাইল ফোন ছাড়াই দেশে ইলেকট্রিক ও ইলেট্রনিক্স পণ্যের বাজার ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। সারা বছর উৎপাদন ও বিপণনের বাইরে ঈদই মূল লক্ষ্য এ খাতের ব্যবসায়ীদের। আট দিনের জন্য লকডাউন তুলে দিলেও প্রত্যাশিত সাড়া পাননি বলে জানিয়েছেন উৎপাদকেরা।
ফেয়ার গ্রুপের চিফ মার্কেটিং অফিসার মেসবাহ উদ্দিন বলেন, "গত সাত দিনে মোবাইল বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে আগের ১৫ দিন বন্ধ থাকায় মাসিক হিসাবে এটি নেতিবাচক থাকবে"।
অন্যদিকে এসি এবং ফ্রিজের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের অর্ধেকের চেয়েও কম বলে জানিয়েছেন মেসবাহ উদ্দিন।