ঈদের মৌসুমে আবারও ক্ষতির মুখে ইসলামপুর কাপড়ের বাজার
ঈদের মৌসুমে আবারও ক্ষতির সম্মুখীন দেশের বৃহত্তর পাইকারি কাপড়ের বাজার পুরান ঢাকার ইসলামপুর। কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নতুন করে লকডাউন ঘোষণা করায় রমজানে ব্যবসায়ীরা নিয়মিত বেচা-বিক্রির প্রায় ৭০ শতাংশই হারিয়েছেন।
আন্তঃজেলা গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা চূড়ান্ত ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। ভরা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুচরা এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঢাকায় আসতে না পারায় ধস নেমেছে কাপড়ের বাজারে।
বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, গত রমজানের চেয়ে এবার বাজারের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো হলেও সাধারণ ঈদের বেচা-বিক্রির তুলনায় এই হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের বেশি হবে না।
বাজারের বার্ষিক ব্যবসার প্রায় ৬০ শতাংশ হয়ে থাকে ঈদ-ঊল-ফিতরকে কেন্দ্র করে। কিন্তু টানা দুবছর ধরে মহামারির কারণে লোকসান গুনছেন বিক্রেতারা। সাধারণত শবে বরাতের দশ দিন আগে থেকে শুরু হয় ঈদের মৌসুম। রমজানের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বজায় থাকে এই ব্যস্ততা।
বাড়তে থাকা কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার শবে বরাতের মাত্র এক সপ্তাহ পর গত ৫ এপ্রিল দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা ৫ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত দোকান বন্ধ রাখেন।
পাকিজা ফেব্রিক কালেকশনসের ব্যবস্থাপক দিদারুল ইসলাম বলেন, 'মূলত ঈদ সামনে রেখে দর্জির কাছে বানানো পোশাকের জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাজার হাজার খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা ইসলামপুরে কাপড় কিনতে আসেন।'
'কিন্তু, আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ থাকায় অধিকাংশ ব্যবসায়ী এবার আসতে পারেননি। আমাদের দোকানও ২০ দিন ধরে বন্ধ ছিল। ফলে আমরাও কোনো বেচা-বিক্রি করে উঠতে পারিনি। ২৫ এপ্রিল থেকে পুনরায় দোকান খোলা হয়,' বলেন তিনি।
এছাড়া, দর্জির কাছে কাপড় বানাতে সময় প্রয়োজন হয় বলে এবার ব্যবসায়ীরা শাড়ির মতো তৈরি পোশাকের দিকে ঝুঁকছেন।
দিদারুল আরও বলেন, 'মহামারি-পূর্ব সময় ঈদের বিক্রির তুলনায় এ বছরের বেচা-বিক্রির মাত্রা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। ২০২০ সালের প্রথম লকডাউন তোলার পর গত ১০ মাসে আমরা সাধারণ সময়ের বিক্রির মাত্র ৪০ শতাংশ পর্যন্ত করতে পেরেছি। গত বছরে মজুদ করা অধিকাংশ পণ্যই বিক্রি হয়ে যাওয়ায় আমরা ঈদের প্রস্তুতি হিসেবে নতুন পণ্য আনি।'
'কিন্তু এখন আমাদের মজুদকৃত পণ্য বিক্রি হবে কি না, তা নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে আছি,' বলেন তিনি।
ঢাকার বাইরেও ক্ষতির মুখে ব্যবসায়ীরা
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ব্যবসায়ী বুলবুল আহমেদ। ঈদের আগে তিনি প্রতি বছর ইসলামপুর থেকে ১৫-২০ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের কাপড় কিনতেন। কিন্তু এ বছর লকডাউন থাকায় তিনি ঢাকা আসতে পারেননি।
তিনি বলেন, 'আমরা সাধারণত নিজেরা ইসলামপুরের বিভিন্ন দোকান ঘুরে প্রতি বছর কাপড় কিনি। এরপর পরিবহনযোগে নওগাঁয় পণ্য পাঠিয়ে দিই। তবে এ বছর আন্তঃজেলা পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় তা করতে পারিনি।'
'আমি ইসলামপুরের পাইকারি দোকানদারদের সাথে ফোনে কথা বলে চার লাখ টাকার পণ্য কিনি, যা আমার মূল চাহিদার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ। বিক্রেতারাই পণ্য আমার কাছে পৌঁছে দেন। ঈদ যেহেতু এগিয়ে আসছে, তাই বিক্রিও বাড়বে বলে আমি আশাবাদী।'
নেত্রকোনার কালমাকান্দা উপজেলার ব্যবসায়ী ঝন্টু সাহা বলেন, 'আমি সাধারণত ঈদকে সামনে রেখে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার কাপড় কিনি। কিন্তু এ বছর ঢাকায় যেতে পারিনি। আমার দোকানে তাই চাহিদা পূরণের মতো যথেষ্ট পণ্য নেই।'
'এই মুহূর্তে আমার দোকানে মাত্র এক লাখ টাকার পণ্য আছে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যানুসারে, ইসলামপুরে ৯৫টি মার্কেটে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি শো-রুম আছে। রাস্তার ধারে ভাসমান দোকানগুলো ধরা হলে এই সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়াবে। এই দোকানগুলোয় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ কাজ করেন।
বিষয়টির উল্লেখ করে বাংলাদেশ বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শামসুল আলম বলেন, 'ইসলামপুরে ঈদ-ঊল-ফিতরকে কেন্দ্র করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেচা-বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্তু গত বছর বাজারে প্রায় কোনো বেচা-বিক্রিই হয়নি। এ বছরও মোট বিক্রির পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকার ওপর যাবে না।'
'আবারও ভরা মৌসুম হারালাম'
প্রতি বছরের মতো এবারও ব্যবসায়ীরা সর্বশেষ ডিজাইন অনুসরণ বিভিন্ন ধরনের কাপড় মজুদ করেছেন। এখানে প্রতি গজ কাপড়ের মূল্য ৪০ টাকা থেকে ১১০ টাকা। অন্যদিকে, এখানে ২৯০ টাকা থেকে শুরু করে ১৮০০ টাকা দামের বিভিন্ন মূল্যের শাড়ি পাওয়া যায়।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত দেশি কাপড়ের বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ এবং বিদেশি কাপড়ের বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশই পূরণ করে থাকে ইসলামপুর। বিদেশি কাপড়গুলো মূলত ভারত, পাকিস্তান, চীন, থাইল্যান্ড এবং জাপান থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
রমজানে ঢাকার ধনী ব্যক্তিরাও যাকাতের জন্য ইসলামপুর থেকে কোটি কোটি টাকার কাপড় কিনেন।
বাংলাদেশ বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাসের উদ্দীন বলেন, 'গত ঈদ-ঊল-ফিতরে আমরা বড় ধরনের ধাক্কা খাই। এবার পুনরায় আমরা বেচা-বিক্রি হারালাম। এমনকি বাজার যদি চাঁদরাত পর্যন্তও খোলা থাকে, বিক্রির পরিমাণ কোভিড পূর্ব সময়ের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের বেশি হবে না।'
সাধারণত নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল ও কেরাণীগঞ্জের বিভিন্ন কারখানার কাপড় এখানে আসে। সুতা ও বস্ত্র প্রস্তুতকারী, ডাইং, প্রিন্টিং, এমব্রয়ডারি, ক্যাটালগ ও প্যাকেজিংয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরাও পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্ত। পুরো খাতটিকে টিকিয়ে রাখতে বেচা-বিক্রি সচল রাখা অত্যন্ত জরুরি।
মহামারির কারণে গত দুই ঈদে বিক্রি কমে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট খাতে জড়িতদের বেতন নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এছাড়া, জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সারা বছর ইসলামপুর থেকে কাপড় কিনে থাকলেও ঈদের বিক্রির পর টাকা পরিশোধ করেন।
কিন্তু এ বছর তাদের অধিকাংশই মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন না।
সম্প্রতি অঙ্গ বসনের ব্যবস্থাপক তন্ময় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রমজানে সাধারণত আমরা ব্যবসার সময় কথা বলার সুযোগও পাই না। কিন্তু এখন আমাদের কোনো ক্রেতা নেই বললেই চলে।'
তন্ময়ের মতো হাজারও পাইকারি বিক্রেতা, যারা কাপড়ের পেছনে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করেছেন, তারা এ বছর অধিকাংশ পণ্যই বিক্রি করতে পারছেন না। অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন। বাজারে কাজ করা অধিকাংশ মানুষই বিক্রি ও ঈদ বোনাস নিয়ে উদ্বিগ্ন।
স্যাটেলাইট প্রিন্ট শাড়ির বিক্রেতা মোহাম্মদ খোকন বলেন, 'আমাদের দোকানে আটজন কর্মী আছেন। আমরা গত বছর কোনো বোনাস পাইনি। কেবল আংশিক বেতন পেয়েছি। এ বছর কী হবে, তা নিয়েও আমরা চিন্তিত।'
তিনি আরও জানান, লকডাউনের কারণে সীমিত সময়ের জন্য ব্যাংক খোলা থাকাও বেচা-বিক্রি কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ। কেননা, ইসলামপুরে আসা খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সাধারণ মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ব্যবসা করেন।