কমদামে নামীদামী পশ্চিমা ব্র্যান্ডের পোশাক কিনতে প্রিয় গন্তব্য যখন নূরজাহান মার্কেট!
"১৯৮৮ সালে সারাদেশে ভয়ংকর বন্যা হলো না? সে বছর বন্যার পর অক্টোবর মাসে মার্কেটটা চালু হয়। মার্কেটজুড়ে ১৫০টার মতো দোকান থাকলেও চালু ছিল মাত্র ৭টা। পাশেই নিউমার্কেটের তখন রমরমা অবস্থা। তাই নূরজাহান মার্কেটে দোকান নিতে বেশি মানুষের আগ্রহ ছিল না। এখানে বেশিরভাগই ছিল শুধু শার্টের দোকান। ফুল শার্ট ছিল ১০০ টাকা আর হাফ শার্টের রেট ছিল ৯০ টাকা। প্রতিদিন দুই-আড়াই হাজার টাকার বিক্রি হতো। দোকানের ভাড়াও ছিল বেশ কম। এক-দেড় হাজার টাকা। সেলসম্যানদের বেতন ছিল ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। প্রায় ৩৪ বছরেরও আগের ঘটনা সেটা,
"হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে সময়ের সাথে মার্কেটের চেহারাও বদলে গেছে পুরাই। এখন সারাদেশে এক নামে সবাই চেনে এই নূরজাহান মার্কেটকে। কমদামে খুচরায় এক্সপোর্ট কোয়ালিটির কাপড়ের জন্য সেরা ঠিকানা এটা," বলছিলেন ঢাকার মিরপুর রোডে অবস্থিত নূরজাহান সুপার মার্কেট বণিক সমিতির সভাপতি মো. সোহরাব হোসেন। ৩৩ বছর ধরে এই মার্কেটে কাপড়ের ব্যবসা করছেন তিনি।
পশ্চিমা ধাঁচের পোশাকের জন্য সারাদেশেই জনপ্রিয় নূরজাহান সুপার মার্কেটের নাম। এমনকি দেশের বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের পছন্দের কেনাকাটার জন্যও অন্যতম আকর্ষণ এই মার্কেট। বর্তমানে চারতলা ভবনের প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় তলায় দোকান আছে প্রায় ৫৬০টি।
যেখানে সব বয়সী মানুষের চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যায় প্যান্ট, শার্ট, টপস, আন্ডার গার্মেন্টস, শীতের কাপড়, ব্যায়ামের জামা-কাপড়সহ সব ধরনের পাশ্চাত্য ধারার পোশাক। মুলত দেশীয় গার্মেন্টেসের রপ্তানিযোগ্য পোশাকের জন্য শুরুতে জনপ্রিয়তা পেলেও বর্তমানে স্থানীয় কারখানায় বানানো পোশাকের আধিপত্যও আছে মার্কেটজুড়ে।
পুরোনো সেই দিনের কথা
নূরজাহান সুপার মার্কেটের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ব্যবসায়ী হাজী শেখ সিদ্দিক। মার্কেটের সাধারণ ব্যবসায়ীরা তাকে সম্বোধন করতেন জমিদার নামে। সোহরাব হোসেনের ভাষ্যে, "পুরান ঢাকার খাজে দেওয়ানে বাড়ি ছিল তার। সদরঘাটে ছিল কাপড়ের ব্যবসা। তখনকার দিনে ছেলেদের 'বাবার স্যুট' খুব বিখ্যাত ছিল। উনি সেগুলোর ব্যবসাই করতেন। সদরঘাটের মার্কেটগুলোতে বেশ ছোট ছোট দোকান ছিল। সেখানকার ধারণা থেকেই নূরজাহান মার্কেটকে তিনি সাজিয়েছিলেন ছোট ছোট দোকান দিয়ে।"
সিদ্দিক সাহেব তার মা-বাবার নামে বিল্ডিংয়ের নামকরণ করেছিলেন হাবিবা ইব্রাহিম ম্যানশন। আর স্ত্রী নূরজাহানের নামে নামকরণ করেছিলেন মার্কেটটির। শুরুতে নিচতলায় কেবল দুই সারি দোকান ছিল। ধীরে ধীরে ক্রেতায় জমজমাট হয়ে উঠলে উপরের তলায় বিস্তৃত হতে থাকে মার্কেট। বছর চারেক আগে মারা যান মার্কেটের প্রতিষ্ঠাতা। মার্কেটের বর্তমান মালিকানা সিদ্দিক সাহেবের চার ছেলে ও তিন মেয়ের। চারতলায় থাকেন মালিক পরিবার।
নূরজাহান সুপার মার্কেটের শুরুতে শার্টের দোকান ছাড়াও ছিল কয়েকটি স্বর্ণের দোকান। কিন্তু গাউছিয়া-নিউমার্কেটের সাথে প্রতিযোগিতায় কয়েক বছরের বেশি টিকে থাকতে পারেনি দোকানগুলো। পাশের হকার্স মার্কেটও ছিল বেশ জনপ্রিয়।
"তখন বঙ্গবাজার, ইসমাইল ম্যানশনে বেশ কিছু দোকান ছিল এক্সপোর্ট আইটেমের। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে ওখান থেকে ব্যবসায়ীরা এসে নূরজাহান মার্কেটে কয়েকটা দোকান দেয়। আমাদের তখন এক্সপোর্টের মাল নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। শুরুর দিকের সেই প্রোডাক্টগুলো এখনকার মতো ভালোও ছিল না। বিভিন্ন ডিজাইনের সোয়েটার, গেঞ্জি ইত্যাদি আসতো শুরুতে।
"এরপর ধীরে ধীরে ভালো কোয়ালিটির এক্সপোর্ট আইটেম আসতে শুরু করে। গার্মেন্টেসের আইটেমগুলোর সেলাই, কালার, ডিজাইন সবই অনেক ভালো। কাস্টমাররা কম দামে এত ভালো প্রোডাক্ট পাওয়ায় তাদের ভরসা বাড়তে থাকে। যারা এক্সপোর্ট কোয়ালিটির জামা-কাপড় কিনতো তারা আর লোকাল প্রোডাক্টে আগ্রহ দেখাতো না," বলেন সোহরাব। এক্সপোর্ট আইটেমের হাত ধরেই নূরজাহান মার্কেটের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে বলে জানান তিনি।
যেভাবে কম দামে সংগ্রহ করা হয় 'এক্সপোর্ট কোয়ালিটি'র পণ্য
১৯৯২ সাল থেকে নূরজাহান সুপার মার্কেটে ব্যবসা করছেন মো. মহসিন ভূঁইয়া। শুরুতে স্থানীয় শার্ট-প্যান্ট বিক্রি করলেও ক্রেতার চাহিদা বুঝে পুরোপুরি ঝুঁকেন গার্মেন্টসের রপ্তানিযোগ্য পোশাকের ব্যবসায়। ট্রাস্ট পয়েন্ট নামের তার দোকানে পাওয়া যায় ছেলেদের সব ধরনের প্যান্ট, টিশার্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি। বর্তমানে মার্কেটের বণিক সমিতির কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন তিনি।
কীভাবে পণ্যগুলো সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে মহসিন বলেন, "সোর্সের মধ্যে এক নম্বরে আছে বঙ্গবাজার। সেখানে বড় বড় হোলসেলাররা বিভিন্ন গার্মেন্টস থেকে মাল নামায়। ওরা আমাদেরকে খবর দিলে আমরা গিয়ে পছন্দমতো সেরা মালগুলো নিয়ে আসি। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা মাল সংগ্রহ করার আগেই চিন্তা করে নূরজাহান মার্কেটে সাপ্লাইয়ের কথা।
"আমরা কিনে আনার পরে যেগুলো বাকি থাকে সেগুলোই ওরা পাইকারি দরে অন্যদের বিক্রি করে। এছাড়া গার্মেন্টস থেকে বিভিন্ন হাউজে মাল নেওয়ার পর সেখান থেকেও আমরা কিনে আনি। অনেকসময় ব্রোকাররা গার্মেন্টস থেকে নানা ধরনের প্রোডাক্টের স্যাম্পল এনে দেখায় আমাদের। সেগুলো থেকেও পছন্দ করে নিয়ে আসি আমরা।
"বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলোতে বিদেশের বড় বড় ব্র্যান্ডের অর্ডার অনুযায়ী পোশাক বানানো হয়। প্রতিটি লটেই অনেক এক্সট্রা পিস বানানো হয়ে থাকে। আবার কখনো কোনো কারণে বিদেশের অর্ডার ক্যান্সেলও হয়ে যায়। সেই এক্সট্রা মালগুলোই কম দামে নিয়ে আসি আমরা। অনেকেই ভাবে রিজেক্ট মাল এগুলো। গার্মেন্টেসের ভাষায় এগুলোকে রিজেক্ট বললেও আমরা সব দেখে-শুনে ভালো প্রোডাক্টগুলোই নিয়ে আসি। কোনো রিজেক্ট মাল মার্কেটে পাওয়া যায় না। ওগুলো আরো কম দামে বিক্রি করে দেওয়া হয় ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছে।"
কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী স্থানীয় অর্ডারের বেশ কিছু পণ্যও পাওয়া যায় এখন নূরজাহান সুপার মার্কেটে। ব্যবসায়ীদের কাছে যেগুলো 'ফ্রেশ অর্ডার আইটেম' হিসেবে পরিচিত। সংগৃহীত হয় মিরপুরের শাহ আলী কলেজ মার্কেট থেকে।
তুরস্ক, চীন, ভারতের মতো দেশ থেকে আমদানি করা কিছু দামি পোশাকও মেলে কয়েকটি দোকানে। পল্টনের পলওয়েল সুপার মার্কেট, কালীগঞ্জের আলম মার্কেট থেকে সেগুলো সংগ্রহ করা হয় বলে জানান মহসিন।
বিদেশি ক্রেতা আর দোভাষী বিক্রেতা
গার্মেন্টসে তৈরি রপ্তানিযোগ্য পোশাক বিক্রির চল শুরু হওয়ার পর নূরজাহান সুপার মার্কেটে বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনাও বাড়তে থাকে। কাজের সূত্রে বা ঘুরতে আসা ভিনদেশি নাগরিকেরা নূরজাহান মার্কেট থেকে খুঁজে নেন তাদের পছন্দসই পোশাক। কেউ কেউ আবার নিজের দেশের হোলসেল মার্কেটের জন্য পাইকারি দরেও কিনে নিয়ে যান এখানকার পণ্য।
মূলত বাংলাদেশি গাইডদের সূত্র ধরেই নূরজাহান মার্কেটে আসতে শুরু করেন বিদেশি ক্রেতারা। বিভিন্ন ফাইভস্টার হোটেলের সঙ্গেও যোগসূত্র থাকে ব্যবসায়ীদের। নানান এয়ারলাইন্সের বিদেশি কেবিন ক্রু-রা এই মার্কেটের অন্যতম ক্রেতা।
বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতার জন্য মার্কেটের প্রায় সব বিক্রেতাই টুকটাক বিদেশি ভাষার জ্ঞান রাখেন বলে জানান মহসিন। তিনি বলেন, "শুরুর দিকে সবচেয়ে বেশি আসতেন রাশিয়ান কাস্টমাররা। তাই মার্কেটের সব ব্যবসায়ীরাই তখন মোটামুটি রাশিয়ান ভাষার টুকটাক জ্ঞান রাখতেন। কিছু কিছু দোকানের বিক্রেতারা কয়েকটা ভাষা জানেন। কাস্টমারদের সাথে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য মার্কেটে কিছু দোভাষীও থাকত। আগে প্রায় প্রতিদিনই অনেক বিদেশি ক্রেতা পেতাম আমরা। হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর তো দেশে বিদেশিদের আসাই কমে গেছে। আর করোনার পর সেটা আরো কমেছে। এখন কম হলেও নিয়মিতই বিদেশি ক্রেতা আসে আমাদের দোকানগুলোতে।"
প্রায় ১২ বছর যাবত এই মার্কেটে গার্মেন্টসের কাপড়ের ব্যবসা করছেন জীবন। আগে বঙ্গবাজার মার্কেটে কাজ করতেন দোভাষী হিসেবে। প্রায় পাঁচ-ছয়টি বিদেশি ভাষায় দক্ষতা আছে তার। দোভাষীর কাজ করার উদ্দেশ্যে নানান ভাষার ব্যাকরণ বই পড়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেছেন বিদেশি ভাষায় আলাপচারিতায়।
ইংরেজি আর হিন্দি ছাড়াও ফার্সি, রাশিয়ান, আরবি, স্প্যানিশ, ইন্দোনেশিয়ান ইত্যাদি ভাষায় ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেন জীবন। দোভাষী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা দুই যুগেরও বেশি সময়ের। বাংলাদেশে আসার আগে পরিচিত ক্রেতারা এখন তার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপেও যোগাযোগ করেন বলে জানান তিনি।
জীবনের দোকানে দেখা হয় ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কেবিন ক্রু ইউক্রেনিয়ান নাগরিক পাবলোর সঙ্গে। দুই ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গী হয়ে নূরজাহান মার্কেটে এসেছেন তিনি। পাবলো বলেন, "বাংলাদেশে আগে একবার আসা হলেও নূরজাহান মার্কেটে এই প্রথম। আমার বন্ধুদের কেনাকাটার প্রিয় জায়গা এটা। শুনেছি এখানে বেশ কম দামে ভালোমানের পোশাক পাওয়া যায়।"
বর্তমান চিত্র
মার্কেটের অলিগলির দোকানগুলোতে নানান বয়সী মানুষের ভিড়। কেউ কেউ ফিরছেন বস্তা ভরে কেনাকাটা করে। কেউ কেউ শপিং করতে করতে ক্লান্ত হয়ে জিরিয়ে নিচ্ছেন সিঁড়িতে বসে। খুচরা কেনাকাটার বাইরে ছোট ব্যবসায়ী ও অনলাইনের বিক্রেতারা পাইকারি দরেও জামা-কাপড় কেনেন এখান থেকে।
নিচতলার এক দোকানে লেডিস প্যান্ট দামাদামি করছিলেন শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির ফ্যাশন ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী রাইসা। তিনি বলেন, "এখানে এক ছাদের নিচে মনমতো সব ট্রেন্ডি জামা-কাপড় পাওয়া যায়। দামটাও ছাত্র-ছাত্রীদের হাতের নাগালে। তাই প্রায়ই শপিং করতে আসা হয় আমার।"
নূরজাহান সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, করোনাকালীন মন্দার ধাক্কা এখনো কাটেনি ব্যবসা থেকে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দোকান ভাড়াও। ৫০-৬০ বর্গফুটের একটা দোকানের মাসিক ভাড়া এখন ৪৫-৬০ হাজার টাকার মতো। দোকানের আয়তন ১০০ বর্গফুটের আশেপাশে হলে মাসিক ভাড়া গড়ায় লাখ-দেড় লাখ টাকায়। সাধারণ সময়ে যে বিক্রি হয়, তা দিয়ে অনেক দোকানের মাসিক ভাড়া মেটানোই কঠিন হয়ে পড়ে। তবে শীতের মৌসুম আর রোজার ঈদে বেশ ভালো বিক্রি হয় এই মার্কেটে।
সাধারণ সময়ে ভালো মালামালসমৃদ্ধ দোকানে দৈনিক ২০-৩০ হাজার টাকা বিক্রি হয় বলে জানান সোহরাব হোসেন। ঈদের সময় বা শীতের মৌসুমে তা ৭০-৮০ হাজার থেকে লাখের উপরেও যায় কখনো কখনো।
নূরজাহান মার্কেট ঘুরে দেখা যায় নানা ডিজাইনের মেয়েদের টপসের দাম ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা, প্যান্ট ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা, ছেলেদের শার্ট ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, প্যান্টের দামও একইরকম। মান অনুযায়ী এই দামের ওঠানামা হয় দোকানভেদে।
নারী ও শিশুদের প্রয়োজনীয় পোশাকগুলো পাওয়া যায় নূরজাহান মার্কেটের নিচতলায়। দ্বিতীয় আর তৃতীয় তলার দোকানে মূলত পুরুষদের পোশাক। মহসিন বলেন, "এখানে বেশিরভাগ কাস্টমারই একটা জামা কিনতে এসে চার-পাঁচটা জামা কিনে নিয়ে যায় কম দাম দেখে। পৃথিবীর কোথাও নূরজাহান মার্কেটের মতো কম দামে এরকম এক্সপোর্ট কোয়ালিটির জামা-কাপড় পাওয়া যাবে না।"