এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বাণিজ্যে নজর বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হতে যাওয়া এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ (এলডিসি) পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যকে টেকসই করতে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক ব্লকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার বাংলাদেশের।
শুক্রবার বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২১-এর চতুর্থ দিনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত "এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক অ্যান্ড বাংলাদেশ: হারনেসিং ইকোনমিক পটেনশিয়ালস" শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এসব বলেন বক্তারা।
বক্তারা বলেন, এই অঞ্চলের দেশগুলোতে বাংলাদেশের আমদানির তুলনায় রপ্তানি অনেক কম, বিনিয়োগও আকর্ষণ করতে পারেনি। অন্যদিকে এ অঞ্চলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক কোন ধরণের ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) নেই।
তাদের মতে, অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে নীতির সংস্কার, পণ্য বৈচিত্র্য, বাজার বৈচিত্র্য, ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া সহজীকরণ, প্রতিযোগিতামূলক কর ও শুল্ক ব্যবস্থা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে আরও কাজ করতে হবে।
ওয়েবিনারটি পরিচালনাকারী ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, "২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পাদিত হয় প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলারের, যার মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল মাত্র ৫ বিলিয়নের"।
তিনি পরামর্শ দেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধির জন্য এশিয়া-প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্টের (অ্যাপটা) মাধ্যমে 'রুলস অফ অরিজিন' শিথিল করতে।
এশীয় দেশগুলোর বাজার সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আরও অধিক দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি দরকার বলে জানান তিনি।
"এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সম্ভাব্য রপ্তানি প্রবৃদ্ধি মোকাবেলায় আরও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) এবং এফটিএ'র জন্য বাংলাদেশ সবসময় আঞ্চলিক উদ্যোগের পক্ষে", যোগ করেন তিনি।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, "রাজস্বে লোকসানের জন্য আমরা এফটিএতে সই করতে দ্বিধা বোধ করছি।"
তিনি বলেন, "বিরোধ নিষ্পত্তি কত সময়ে সম্পন্ন হয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এটা জানতে চান। সিঙ্গাপুরে যেখানে ৬০ দিনে বিরোধের নিষ্পত্তি হয়, সেখানে বাংলাদেশে সময় লাগে ১,৫০০ দিন"।
তিনি আরও বলেন, "কর ব্যবস্থা একটি বড় ইস্যু। ট্যাক্স হারের চেয়ে ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সমস্যায় পড়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছে। তাছাড়া ব্যবসা শুরু করার জন্য আরো শত ধরণের অনুমোদন নিতে হয়, মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়"।
এছাড়া ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার, নিয়ন্ত্রণের স্বচ্ছতা, জ্বালানি ও বিদ্যুতের সমস্যা এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব সহ নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনীতিই অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেবে। চামড়া খাতের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী ফুটওয়্যার শিল্পে বাজারের শীর্ষে থাকা ১০ নেতার মধ্যে ছয়জনই এশিয়ার।
"ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের (এফডিআই) জন্য আমাদের এশিয়ার দিকে নজর দেওয়া দরকার," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আঞ্চলিক ব্লকের সঙ্গে যুক্ত করে এবং বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করে এক নতুন স্তরে নিয়ে যেতে জোর দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন।
এছাড়া বিভিন্ন নীতিমালার সময়োপযোগী বাস্তবায়ন, নিয়ম সহজ করা, এয়ারপোর্টসহ লজিস্টিকস সেবা উন্নত করা এবং ব্যবসায়ীদের প্রতি আস্থার রাখার উপর গুরুত্ব দেন নাসিম।
বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেছেন, তার দেশ জাপান বাংলাদেশকে চায়না প্লাস গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশকে এফটিএ থেকে সরে না থাকার আহবান জানিয়েছেন নাওকি।
ওয়েবিনারে তিনি জানান, জাপানের মিতসুবিশি মোটর কোম্পানি ইতিমধ্যে বাংলাদেশে একটি সিকেডি প্ল্যান্টের 'ফিজিবিলিটি স্টাডি' সম্পন্ন করেছে। তাছাড়া বিনিয়োগের জন্য শীঘ্রই আড়াইহাজারে জাপান অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্মুক্ত করে দেয়া হবে যেখানে ১০০টি কোম্পানি স্থান পাবে।
এছাড়া কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার (টিটি) কে স্বীকৃতি দেওয়ার উপর গুরুত্ব দেন তিনি।
বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, "আঞ্চলিক ব্লক বা বাণিজ্য ব্লকগুলো ব্যবসা বৃদ্ধিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং কয়েকটি এশিয়ান দেশ ব্যাপকভাবে প্রবৃদ্ধি করছে এবং বাংলাদেশের জন্যও এটির অংশ হওয়ার সুযোগ রয়েছে।"
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, "এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বাংলাদেশের ইতিমধ্যেই প্রমাণিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক। বাংলাদেশ চীন ও ভারতের মতো দুটি বড় অর্থনৈতিক শক্তির কাছাকাছি কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত এবং এটি আমাদের জন্য একটি সুযোগ। তাছাড়া বিনিয়োগের জন্য আমাদের স্থানীয় বাজার একটি অত্যন্ত লাভজনক এবং আকর্ষণীয় গন্তব্য"।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, "এফডিআই আকৃষ্ট করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একটি উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থার প্রস্তাব করছে। পিটিএ বা এফটিএ স্বাক্ষরের বিষয়ে বাংলাদেশ আরও ১০টি দেশের সাথে আলোচনায় রয়েছে এবং শীঘ্রই দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।"
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের ( ইউনেসক্যাপ) ডেপুটি হেড এবং সিনিয়র ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার ডা. রাজন সুদেশ রত্না নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রক্রিয়া সরলীকরণ, ইজ অফ ডুয়িং বিজেনেসের উন্নয়ন এবং সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া সহজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরেও আরও কয়েক বছর বিদ্যমান সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখার জন্য আলোচনায় যেতে পারে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, ইউরোপের চাইতে এশিয়াতে ট্রেড কস্ট বেশি। এর মূল কারণ অবকাঠামোগতভাবে পিছিয়ে থাকা।
ওয়েবিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ।