এসএমই খাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতির দাবি
করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) অব্যাহতিসহ সব ধরণের কর রেয়াত দেওয়ার প্রস্তাব করেছে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স কমানো, অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) প্রত্যাহার ও টার্নওভার ট্যাক্স রেট কমানোর সুপারিশ করেছেন তারা।
এছাড়া, চলমান কোভিড পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানিখাতের শ্রমিকদের মে-জুলাই পর্যন্ত তিন মাসের বেতন ও দুই ঈদের বোনাস পরিশোধে গত বছরের মতো প্রণোদনার পাশাপাশি চলমান বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেছেন তারা।
বৃহস্পতিবার অনলাইনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা এসব দাবি তুলে ধরেছেন। সভায় অংশ নেওয়া অর্থমন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
মিটিংয়ের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'ব্যবসায়ীদের দাবি পর্যালোচনা করে কতটা গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাজেট টিম এবং বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থমন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করব'।
প্রণোদনা প্যাকেজ অব্যাহত রাখার দাবি সম্পর্কে তিনি বলেন, 'ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর হাতে, নিশ্চয়ই তিনি ভাবছেন'।
মন্ত্রী বলেন, স্থানীয় শিল্প বিকাশ ও অর্থনীতি চাঙ্গা করা মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রাজস্ব বাড়ানোর বিষয়ে বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। তবে রাজস্ব বাড়াতে কাউকে বাড়তি কষ্ট দেওয়া হবে না।
এআইটি ও অ্যাডভান্স ট্যাক্স (এটি) বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, 'স্থানীয় শিল্প থেকে হোলসেল ও হোলসেল থেকে রিটেইলার পর্যন্ত সব ধরণের ট্রানজেকশন ইনভয়েসের ভিত্তিতে ব্যাংক টু ব্যাংক করার বিধান করলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে, ব্যবসায়ীরাও বাড়তি কর থেকে রেহাই পাবেন'।
'সিমেন্ট খাতের এআইটি বাবদ গতবছর এনবিআরে জমা ছিল ৭০০ কোটি টাকা, যা এবার ১২০০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। সময়মত সমন্বয় করে বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়া হলে এ খাতের ব্যবসায়ীদের প্রণোদনার ঋণ নিতে হতো না', যোগ করেন তিনি।
ফাহিম বলেন,রপাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ০.৫% হারে টার্নওভার ট্যাক্স নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। ভ্যালু চেইন আপগ্রেডেশন, প্রোডাক্ট ডাইভারসিফিকেশনকে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, মে-জুলাই সময়ে শ্রমিকদের বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধে গত বছরের মতো প্রণোদনা দরকার।
পোশাক রপ্তানির ওপর বিদ্যমান ১% ক্যাশ ইনসেনটিভ সুবিধা আগামী অর্থবছরও বহাল রাখা ও রেয়াতি হারে করপোরেট ট্যাক্স সুবিধা আগামী পাঁচবছর অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেন তিনি।
রপ্তানির বিপরীতে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তার ওপর বিদ্যমান ১০ শতাংশ উৎস কর কমিয়ে ৩% নির্ধারণের প্রস্তাব করে বিকেএমইএ'র প্রথম সিনিয়র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে ব্যবহৃত রাসায়নিক আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করা প্রয়োজন'।
হাতেম বলেন, 'শতভাগ ভ্যাটমুক্ত হওয়ার পরও আমাদের প্রতিমাসে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে হচ্ছে, যার কোন প্রয়োজন নেই। এছাড়া, স্থানীয় টেক্সটাইল মিলের উৎপাদিত সুতা কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করায় ৭০ভাগ নিটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্সের দরকার হয় না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ড লাইসেন্স করতে চাপ দিচ্ছে'। এর থেকে অব্যাহতি চান তিনি।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, 'বিভিন্ন সেক্টর নিয়ে গবেষণা করে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এখনও ব্যবসার ক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ উচ্চ কর হার ও কর প্রশাসনের হয়রানি। কাগজে-কলমে এনবিআর ব্যবসাবান্ধব হলেও বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। বিএসআরএমের কাছ থেকে এআইটি বাবদ এনবিআর প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আদায় করলেও তা সমন্বয় করার কোন উদ্যোগ নেই'।
তিনি বলেন, 'এসএমই খাত অর্থনীতির মূল শক্তি হলেও তারা প্রণোদনার অর্থ পায়নি। এসএমই খাতকে পুনরুজ্জীবিট করতে না পারলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন বাড়বে না, তেমনি বৃহৎ শিল্পও ভালো করতে পারবে না'।
আগামী বাজেটে এসএমইগুলোর দোকান ভাড়া ও কর সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো চালু রাখার সুপারিশ করে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, এসএমইখাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে এলাকাভিত্তিক চেম্বার, এসোসিয়েশনগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, বছরে ৩ কোটি টাকার বেশি টার্নওভার হলে ০.৫% টার্নওভার ট্যাক্স বহাল থাকলে খাতুনগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের কোন পাইকারি ব্যবসায়ী টিকতে পারবে না। তিনি এ হার কমানোর প্রস্তাব করেন।
একটি শিল্প গ্রুপের অধীনে ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ঋণখেলাপি হলে অন্য ৯টি প্রতিষ্ঠানকেও ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ঋণ খেলাপি না হয়েও বাকি ৯টি প্রতিষ্ঠান এলসি খুলতে পারছে না। এ পরিস্থিতি থেকে অব্যাহতি চান তিনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, সুতার ওপর ৪% ভ্যাট আরোপ হলেও দেশের গরীব মানুষের কাপড় তৈরিতে ব্যবহৃত ম্যান মেইড ফাইবারের ওপর ৬% ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। তিনি সব ধরণের সুতার ওপর ৩% ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব দেন। এছাড়া, বিদেশ থেকে থ্রি-পিস ও কাপড় আমদানির ক্ষেত্রে ট্যারিফ ভ্যালু বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি।
ওভেন রপ্তানিকারকদের কাঁচামালের চাহিদা মেটাতে বছরে প্রায় ৪ বিলিয়ন মিটার কাপড় আমদানি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের উইভিং মিলগুলোকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে তা দেশেই উৎপাদন সম্ভব। এজন্য আইনী জটিলতা দূর করার কথা বলেন তিনি।
পোস্ট কোভিড অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আগামী বাজেটে স্থানীয় শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে সহজ ও ব্যবসাবান্ধব কর নীতি প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ঢাকা চেম্বারের প্রেসিডেন্ট রিজওয়ান রাহমান বলেন, বাংলাদেশে ৩২.৫% করপোরেট কর দিয়ে ব্যবসা করতে হয়, যা এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতিবছর ২.৫% পার্সেন্টেজ পয়েন্ট হারে করপোরেট ট্যাক্স কমানোর প্রস্তাব করেন তিনি।
স্থানীয় বাজারে পাটপণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া ও বিভিন্ন রপ্তানিমুখী খাতকে আরএমজি সাকসেস মডেল অনুসরণ করে পলিসি সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
বাংলাদেশে অপ্রত্যক্ষ কর অনেক বেশি উল্লেখ করে ফরেন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট রূপালী হক চৌধুরী বলেন, 'প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স কমানো হলেও অপ্রত্যক্ষ কর এখনও অনেক বেশি। প্রমোশনাল এক্সপেনডিচার ও ফরেন ট্যুরের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সীমা প্রত্যাহার প্রয়োজন। ৪% এডভান্স ট্যাক্স নেওয়ার পর ১৫% ভ্যাট ব্যবসায়ীদের বাড়তি চাপে ফেলছে'।
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স কমানোর সুপারিশ করেন তিনি।
এসএমইখাতের ট্যাক্স প্রত্যাহারের সুপারিশ করে তিনি বলেন, 'তাদের টিকিয়ে রাখতে পলিসি সাপোর্ট দিতে হবে, যারা প্রণোদনা পায়নি, তাদের দিকে নজর দিতে হবে'।
লেদারগুডস এন্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট মো. সাইফুল ইসলাম এআইটি ও নগদ সহায়তার ওপর আরোপিত সোর্স ট্যাক্স প্রত্যাহারের সুপারিশ করে বলেন,' রপ্তানিক্ষেত্রে ইউনিট প্রতি মূল্য কমে গেছে। ফলে খরচ কমাতে গিয়ে আমাদের শ্রমিক ছাঁটাই করতে হবে'।
বাংলাদেশ উইম্যান চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট সেলিমা আহমাদ নারী উদ্যোক্তাদের মূলধন যোগান ও তাদের প্রশিক্ষণে আগামী বাজেটে ২০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দাবি করেন। নতুন নারী উদ্যোক্তাদের তিন বছরের জন্য কর-ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
এক কোটি টাকার কম টার্নওভার এমন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ও অনলাইন কেনাকাটায় ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে ভ্যাট মওকুফ করার সুপারিশ করেন ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) প্রেসিডেন্ট শমী কায়সার।
কর ও ভ্যাট সংক্রান্ত ব্যবসায়ীদের দাবি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'শুল্ক-করের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর দাবি করেছেন। নতুন নতুন কিছু জায়গায় ছাড় দেয়ার কথা বলেছেন, সেগুলো আমরা বিবেচনা করব'।
নতুন বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ চেয়ে ব্যবসায়ীরা আগেই চিঠি দিয়ে রেখেছেন জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের সিস্টেমের কারণে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে কিছু কালো টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। আজকের মিটিংয়ের কালো টাকা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে এর অর্থ এই নয় যে তারা দাবি করেন নি'।