ওয়ালটনের বিশ্বজয়ের অভিযান
ওয়ালটনকে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে 'ওয়ালটন করপোরেশন ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা' নামে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান চালু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ।
গৃহস্থালির ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারী এই প্রতিষ্ঠান সাধারণ এবং অগ্রাধিকার বা প্রেফারেন্স উভয় ধরনের শেয়ার কিনতে পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন লাভের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।
উত্তর আমেরিকায় আমদানি, রপ্তানি এবং চুক্তি অনুযায়ী ক্রয় প্রক্রিয়া চালাবে ওয়ালটন ইউএস। সম্প্রতি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটি এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
এছাড়া, বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বাজার বিস্তারের লক্ষ্যে ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, নেপাল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতেও প্রাতিষ্ঠানিক শাখা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওয়ালটন পরিচালনা পর্ষদ।
বিদেশি শাখা এবং লিয়াজোঁ কার্যালয় পরিচালনায় ওয়ালটন বৈদেশিক মুদ্রার সীমা বৃদ্ধি আবেদন করার পরিকল্পনা করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের প্রথম স্থানীয় বৃহৎ ইলেকট্রনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়ালটন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক শাখা স্থাপন করতে চলেছে।
ওয়ালটনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মুর্শেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে আমাদের স্থানীয় চাহিদার ঘাটতি পূরণ হবে। আর তাই, ২০৩০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়াই আমাদের লক্ষ্য। লক্ষ্য পূরণের অংশ হিসেবে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক দপ্তর চালু করা শুরু করেছি।"
"২০৩০ সালের মধ্যে আমরা বিশ্বের প্রথম সারির পাঁচটি ব্র্যান্ডের মধ্যে ওয়ালটনের নাম দেখতে চাই।"
স্থানীয় বাজারে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ওয়ালটন এবং মার্সেল- এই দুই নামধারী ব্র্যান্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
১৯৯৭ সালে বড় ভাই এসএম নুরুল আলম রিজভীর নেতৃত্বে পাঁচ ভাই মিলিতভাবে সাদা-কালো টেলিভিশন সেট আমদানির ব্যবসা শুরু করে। তখন তারা ভাবেননি যে একদিন এই প্রতিষ্ঠান এত বিশাল রূপ ধারণ করবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে উচ্চারিত হবে ওয়ালটনের নাম।
টেলিভিশন বিক্রিতে সফলতা লাভের পর প্রতিষ্ঠানটি আরও বড় ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন শুরু করে ওয়ালটন।
মোটরসাইকেল এবং রেফ্রিজারেটর নিয়ে ওয়ালটন যাত্রা শুরু করে। তবে রেফ্রিজারেটরের মতো মোটরসাইকেল ততোটা সাড়া জাগাতে পারেনি।
বর্তমানে, দেশের গৃহস্থালি ইলেকট্রনিক পণ্য বাজারের ৬০ শতাংশ ওয়ালটনের দখলে। স্থানীয় রেফ্রিজারেটর বাজারের দুই-তৃতীয়াংশ, টেলিভিশন বাজারের অর্ধেক এবং এয়ার কন্ডিশনার বাজারের এক তৃতীয়াংশের দখল নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এখন বিশ্ববাজারে সফলতা অর্জনের স্বপ্নে বিভোর। বর্তমানে, বিশ্বে প্রায় ৪০টি দেশে ওয়ালটন ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি করে থাকে।
লিফটের বাজারে একদম নতুন হলেও স্থানীয় এই ব্র্যান্ডটি ইতোমধ্যে বাজারের এক-চতুর্থাংশ দখলে লক্ষ্য নিবিষ্ট করেছে।
মুর্শেদ বলেন, "আমরা ২০০৮ সাল থেকে আমাজনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য বিক্রি করে আসছি। এছাড়া, আমরা সেখানে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে থাকি। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের গৃহস্থালি পণ্যের চাহিদার কারণেই আমরা সেখানে বাজার সম্প্রসারণে আগ্রহী হই।"
প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়ালটন মানুষের জীবনধারাকে সহজ করে তোলার পাশাপাশি দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে বলেও মন্তব্য করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
"গৃহস্থালি পণ্যের বাজারে উচ্চমানের পণ্য সরবরাহ ছাড়াও ওয়ালটন সরাসরি ২৫ হাজার এবং পরোক্ষভাবে এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে, আমরা বিদেশেও পণ্য রপ্তানি করছি," বলেন তিনি।
ওয়ালটনের বিপণন ব্যবস্থা দেশজুড়ে বিস্তৃত। ওয়ালটন প্লাজা নামে ৩৫০টি বিক্রয় কেন্দ্রসহ প্রতিষ্ঠানটির ডিলার সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি।
২০১৯-২০ অর্থবছরে, ওয়ালটন চার হাজার ১০৭ কোটি টাকার ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি করে ৭২৬ কোটি টাকা লাভ করে। এছাড়া, সে বছর প্রতিষ্ঠানটি দেশের বাইরে ১৪ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে, ওয়ালটন দুই হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা মূল্যের রেফ্রিজারেটর এবং কমপ্রেসর, ৩৪৮ কোটি টাকা মূল্যের এয়ার কন্ডিশনার, ৭১৩ কোটি টাকার টেলিভিশন, ২২৭ কোটি টাকার ইলেকট্রনিক পণ্য এবং ১৮৪ কোটি টাকার গৃহস্থালি পণ্য বিক্রি করে।
মহামারির কারণে ১৯-২০ অর্থবছরে রেফ্রিজারেটর বিক্রি আগের বছরের তুলনায় ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। তবে, একই বছর এয়ার কন্ডিশনের বিক্রি ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, টেলিভিশন সেট বিক্রির পরিমাণ বাড়ে ৯৩ শতাংশ। এছাড়া, ইলেকট্রনিক পণ্যে এক হাজার ৬৮৫ শতাংশ ও গৃহস্থালি পণ্যে বেচাবিক্রির হার ১৫১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি লাভ করে।
ওয়ালটনের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চীফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার আবুল বাশার হাওলাদারের মতে, আগের বছরের তুলনায় চলতি অর্থ বছরের প্রথম নয় মাসে দশ গুণ রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির আয়ের পরিমাণ ১৬ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। চলতি অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রতিষ্ঠানটি দুই হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার আয় নিশ্চিত করে।
প্রথম নয় মাসের হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের পরিমাণ চার হাজার ২৯২ টাকা।
রেফ্রিজারেটর এবং এয়ার কন্ডিশনারের মতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণকারী পণ্য বিক্রির পরিমাণ বাড়লেও সবকিছু ছাড়িয়ে দেশ এবং বিদেশে ওয়ালটনের টেলিভিশন বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ওয়ালটনের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রায় দশ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ লাখ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে বলে জানান আবুল বাশার হাওলাদার। এছাড়া আগে বাইরে থেকে শীতাতপ পণ্যের ক্রয়াদেশ বেশি আসলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি টেলিভিশনের জন্য সবথেকে বেশি অর্ডার পেয়ে থাকে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে, শীতাতপ পণ্যের বাজারও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান তিনি। প্রথম নয় মাসে, প্রতিষ্ঠানের মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশই এসেছে শীতাতপ পণ্যগুলো থেকে।
২০২০ সালে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড পুঁজি বাজারের তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে ডিএসইতে ওয়ালটনের প্রতিটি শেয়ারের মূল্য এক হাজার ৩১০.৮০ টাকা।
শেয়ার মূল্য অনুযায়ী বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বাজার মূলধন বা মার্কেট ক্যাপের পরিমাণ ৩৮ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা।
গত বছর, ওয়ালটন বিনিয়োগকারীদের ২০০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ প্রদান করে।
মঙ্গলবার, ডিএসইতে ওয়ালটনের শেয়ার মূল্য ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ বা ২৪.৮০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Walton's globe trotting